Menu Close

“মাটির দেয়াল”-এর কবি অমিয় চক্রবর্তী
রণদেব দাশগুপ্ত

কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থের ‘সমুদ্র’ নামক কবিতার একটি অংশ নমুনা হিসেবে নেওয়া যাক।

“নীল কল। লক্ষ লক্ষ চাকা। মরচে-পড়া। শব্দের ভিড়ে
পুরোনো ফ্যাক্টরি ঘোরে।
নিযুত মজুরী খাটে পৃথিবীকে
বালি বানায়, গ্রাস করে মাটি, ছেড়ে দেয়, দ্বীপ রাখে,
দ্বীপ ভাঙে; পাহাড়, প্রবাল পুঞ্জ, নুনযন্ত্রে
ঘর্ঘর ঘোরায়। ধোঁয়া নেই। নব্যতন্ত্রী
ঐটুকু। আকাশের কারখানা ঢাকা-ডাইনামো,
শব্দ নেই। রাত্রে বারান্দায় ভাবি সমুদ্র কখন হবে শব।”

এ-ভাবেই ওয়ালেস স্টিভেনস তাঁর Sea Surface Full of Clouds-নামক কবিতায় একটি যন্ত্রের বর্ণনা দিয়েছেন। ইন্দ্রিয়গম্য বর্ণনা না করে অনুষঙ্গ ও ব্যঞ্জনার মাধ্যমে শব্দের বুনোটে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য রূপ ফুটিয়ে তুলেছেন। অমিয় চক্রবর্তীও ইলেকট্রিক ফ্যানের গুঞ্জনে শুনেছেন মন্ত্রের ওঁ, আকাশকে দেখেছেন হাতঘড়ির রূপে।

“ইচ্ছে করে প্রতি ঘটনার সঙ্গে তার নাট্যযুক্ত পরিমন্ডল ঠারেঠোরে পৌঁছিয়ে দেই” (ছন্দ ও কবিতা, অমিয় চক্রবর্তী)। স্টিভেনসের মতো অমিয় চক্রবর্তীও বিষয়ের গুরুত্ব বৃদ্ধি করেছেন লঘু সুর আমদানি করে। যেমন দেখা যায় তার ‘চেতনা স্যাকরা’, ‘বড়োবাবুর কাছে নিবেদন’ প্রভৃতি বিখ্যাত কবিতায়।

জার্মান কবি রিলকের সঙ্গেও তাঁর মিল ছিল অন্য এক মানদণ্ডে। আন্তর্জাতিক চেতনায় এবং কবিগোষ্ঠীনিরপেক্ষতায় এই মিল দু-জনের। দু-জনেই মনে করতেন, কেবল অনুভব নয় — কবির নির্ভরতা থাকবে তার জাগতিক অভিজ্ঞতার ভারে।

অমিয় চক্রবর্তীর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আমরা প্রথম পেতে শুরু করি তাঁর ‘তীর্থযাত্রা’ কবিতাটি থেকে—

“দেবালয় বাঁধা ঘাট, বেলগাছে পথ ছায়াঢাকা,
নিভৃত গঙ্গার তীর, একা সাধু গাইছে দেউলে,
মধ্যাহ্ন আকাশে চিল সঞ্চারি বেলায় মেলি পাখা,
… … …
অদূরে রেলের সাঁকো, কলের উঠেছে ধূম্র চূড়া,
… … …
একান্তে এই ছবি দেখি ক্ষণিকের পাত্র হল পুরা।”

দৃষ্টির দর্শনের কবি অমিয় চক্রবতীর কবিতা অসম্পূর্ণ বাক্য, টুকরো টুকরো ছবি, অস্পষ্ট ইঙ্গিত ও আভাসে ভরা—

“ছোটো আপন আকাশ
ছবির আধার
আভার বাতাস।”
(‘প্রবাসী’ — “মাটির দেয়াল”)

অথবা

“ফেলো ছায়া
ফেলো রঙ কবিতার কাঁচে
রঙীন আগুনী কাঁচে
ঘন মায়া, ঘন মায়া।”
(‘শঙ্করাভরণ’ — “মাটির দেয়াল”)

অক্সফোর্ডের প্রভাবে কবির সৃষ্টিতে পড়ল পশ্চিমের আলো। তৎকালীন ইংরেজি সাহিত্যের বৃত্তে তখন কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বীয় ধারণা ও সিগমুন্ড ফ্রয়েডের বৈজ্ঞানিক মনস্তত্ত্বের ঘনিষ্ঠ ছায়া। অমিয় মার্কসকে প্রথানুগতিক ঢঙে গ্রহণ করলেন না। ফ্রয়েডেও তাঁর নজর ততটা ছিল না, যতটা ছিল আধুনিক বিজ্ঞানমনস্কতায়। চেতনে-অবচেতনে দুর্জ্ঞেয় মানুষের অন্তর্লোক — রবীন্দ্রনাথের ভাষায়— “ছায়াপথের” মতো, তাকে প্রকাশ করতে গেলে ভাষার প্রচলিত সারল্য ও স্পষ্টতা সর্বদা যথেষ্ট হয়ে ওঠে না। নবযুগের কবি অমিয় চক্রবর্তী মনঃসমীক্ষণের ইশারাপূর্ণ বাকপ্রতিমায় কোথাও কোথাও নিজেকে জানিয়েছেন। যেমন—

“গিয়েছি শিকড় বেয়ে নামি
মাটির নীরবে এসে থামি
ভূমিকায়।
তখন মধ্যাহ্নবেলা, তবু মোর জ্ঞানে
দিন রাত্রি চোখ-বোঁজা
এক দৃষ্টি।

সঞ্চার হতেছে সৃষ্টি
রচনার ঘরে।

সত্তার আধার।
শিকড় মিশেছে। মাটি-মেঘ
অণুর গোধূলি-মিলা।
প্রদোষে
ওঠে শিরা বেয়ে পাতা
চেতনার দিগন্তরে।
আমার মরণ?
কুসুমিত ধূলি
সন্ধ্যার কণায় ফিরে আসা
মগ্নতার স্তরে।
স্মৃতিরশ্মিহারা সেই খনির আসন।
বারবার
সেথা হতে উপরেতে ভাসা
দিনের কিনারায়।”
(‘নামা-ওঠা’ — “খসড়া”)

অমিয় চক্রবর্তীর কবিতাদর্শনের আর একটি উল্লেখযোগ্য বাঁক আমাদের চোখে পড়ে তার “অভিজ্ঞান-বসন্ত” কাব্যটি থেকে। চেতনার সামগ্রিক সংহতির উঠোনে তিনি আনতে চাইলেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা — আনন্দ, বিষাদ, বিস্ময়, বিভ্রম, বিমূঢ়তা… কবি বললেন সব অভিজ্ঞতার শেষ আমাদেরই অন্তর্লোকে, বহির্জগতে নয়। ‘সংগতি’, ‘বীজমন্ত্র’ এ-সব কবিতায় এই ভাবনার পরিচয় স্পষ্ট। কবিকে হতে হবে স্থিতপ্রজ্ঞ, নিরাসক্ত, ধ্যানী। পার্থিব আসক্তি ত্যাগ না করলে বৈরাগ্যের উদার প্রশান্তি লাভ।

“আজ অন্য লগ্নে দাঁড়িয়েছি,
শূন্যে অন্য দৃষ্টি বাড়িয়েছি।”
(‘প্রতীক্ষা-বিদায়’, “অভিজ্ঞান-বসন্ত”)

অমিয় চক্রবর্তী মনে করেন, বিশ্বভুবনের সকল কিছুই হতে পারে কবিতার বিষয়। “রাস্তায় ঘাটে কবিতা ছড়ানো; সিঁড়ির ধাপে, ঐ পাশের দরজার পিতলের কড়াটা পর্যন্ত ছবির অঙ্গ।” বিষয়বস্তুর এই সার্বিকতার একটি আপাতলঘু অথচ জটিল ও গভীর দর্শনের উদাহরণ কবির “এক মুঠো” কাব্যগ্রন্থের ‘চেতনা স্যাকরা’ কবিতাটি।

“সোনা বানাই

গলিতে, তোমাদের অতীব নোংরা গলিতে,
সোনার সুন্দর, রূপোর রূপকার, এই নর্দমার দোকান দেহলিতে
ধ্যান বানাই। এই আমার উত্তর।
ড্রেন, ধুলো, মাছি, মশা, ঘেয়ো কুত্তার
আড়ৎ বেঁধে আছ, বাঁচো (কিমাশ্চর্য বাঁচা) এবং
যমের কৃপায় মরা

নই নৈতিক পল্টন, সভার বক্তা ইত্যাদি।
শুধু জানি আগুন, আগুনের কাজ, সৃষ্টির আগুন লাগলে প্রাণে
তীব্র হানে বেদনা জাগবার, আর্টের আগুন, মরীয়াকে টানে।”

স্বর্ণালংকার বানাবার জন্য যে আগুন — যা ধ্যান-সৃষ্টির শিল্পসৃজনের মেধা, তেজ-শক্তি — আগুন। এই ব্যাপারে আপাত-নগণ্য স্যাকরা আর কবির একই ভূমিকা। দু-জনেই শিল্পী। স্যাকরার নামটিও এখানে এই তাৎপর্য বহন করে বইকী।

অমিয় চক্রবর্তীর কবিতাভাবনায় ব্যক্তি ও সমষ্টির জীবনে সম্যক পূর্ণতা আসবে ভালবাসায় আর ধ্যানযোগে। সকলের জীবনে সার্থকতা ঘটবে বিজ্ঞান আর কল্যাণের মিলনে। অমিয় মনে করছেন ব্যক্তিগত সমস্যা বিবাদ-বিসংবাদ সবই মিটে যাবে প্রেমের মমতায়। কেননা, প্রেমই পারে আত্মকেন্দ্রিক সংকীর্ণতাকে সর্বকেন্দ্রিক উদারতায় মুক্তি দিতে। অখণ্ড ও গহন দৃষ্টিশক্তি প্রেমেরই দান। যেমন এই কবিতাংশটি—

“তার বদলে পেলে—
সমস্ত ঐ স্তব্ধ পুকুর
নীল বাঁধানো স্বচ্ছ মুকুর
আলোয় ভরা জল—
ফুলে নোওয়ানো ছায়া ডালটা
বেগনি মেঘের ওড়া পালটা
ভরল হৃদয়তল—
একলা বুকে সবই মেলে।”
(‘বিনিময়’ — “পারাপার”)

অমিয় চক্রবর্তীর প্রেমের কবিতায় সর্বদাই বিরহাভাস। তিনি বলেন: এবার মিলন শুধু বিরহ উৎসবে। ‘বিরহান্ত’, ‘চিঠি’, ‘বৃষ্টি’, ‘বিনিময়’, ‘ছবি’ — এ-সবই এর উদাহরণ। আরও দু-একটি প্রাসঙ্গিক দৃষ্টান্ত—

“কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।”

অথবা

“হৃৎপিণ্ডে রক্তের ধ্বনি যেখানে মনের শিরা ছিঁড়ে
যাত্রী চলে গেল পথে কোটি ওক্লাহামা পারে লীন
রক্তক্রশে বিদ্ধক্ষণে গির্জে জ্বলে রাঙা সে তিমিরে—
বিচ্ছেদের কল্পান্তরে প্রশ্ন ফিরে আসে চিরদিন।”
(‘ওক্লাহোমা’)

এই কবির কবিমানসী অদৃশ্যপুরে প্রচ্ছন্নগামিনী। রবীন্দ্রনাথের মতোই অমিয়ও বিরহে শেষ অবধি কোনো সান্ত্বনা বা পূর্ণতা পাননি। ব্যক্তিবিরহের বেদনায় তিনি ডুব দিয়েছেন সত্তার গভীরে। আর সেখানে অমিয় এই উপলব্ধিতে পৌঁছোচ্ছেন যে, পৃথিবীময় মানবের যে দুঃখ, বিক্ষোভ, সঙ্কট, জটিলতা, দুর্গতি, অসহায়তা — সে-সবই দূর হতে পারে একমাত্র উদ্বোধিত আত্মার সর্বশক্তিতে। মেধায়—প্রতিভায়—কর্মোদ্যমে সাধনার সহায়তায়। কবি সুধীন্দ্রনাথের মতো অমিয় হতাশাপূর্ণ বিষাদগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত নন, তাঁর কাব্যদৃষ্টি নিবদ্ধ মুক্তি ও উদয়ের পথের দিকে।

অমিয় চক্রবর্তীকে কেউ কেউ বলেছেন ‘বৈজ্ঞানিক মরমিয়াবাদী’। এবং এ-কথা ঠিক যে, বিজ্ঞানচেতনার নির্ভুল পরিচয়ও স্পষ্ট হয়ে ফুটেছে তার কোনো কোনো কবিতায়। অমিয়র মর্মে নিহিত ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, গান্ধী রম্যাঁ, রঁল্যা, সোয়াইৎজার প্রমুখ দিগদর্শী মহামানবেরা। তাই হয়তো এই ছোটখাটো মানুষটির চোখদুটিতে বড়ো ব্যথার্দ্র দৃষ্টি ছিল। তাই হয়তো তাঁর রচনার গভীরে ছিল আবিশ্ব করুণা। কবি অমিয় শুধু নরনারীকে ভালবেসেছেন তা নয় — পশু-পাখি-কীট-পতঙ্গ… নিখিল জগতের সমস্ত প্রাণীকেই দেখেছেন মমতার চোখে। যেমন—

“আহা পিঁপড়ে ছোটো পিঁপড়ে ঘুরুক দেখুক থাকুক
কেমন যেন চেনা লাগে ব্যস্ত মধুর চলা

আলোয় গন্ধে ছুঁয়ে তার ঐ ভুবন ভরে রাখুক,
আহা পিঁপড়ে ধুলোর রেণু মাখুক।”
(‘পিঁপড়ে’ — “পারাপার”)

Spread the love

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *