Menu Close

“মাটির দেয়াল”-এর কবি অমিয় চক্রবর্তী
রণদেব দাশগুপ্ত

১৯০১ সাল। অধুনা পশ্চিমবঙ্গের শ্রীরামপুরে জন্মাচ্ছেন অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তী — পরবর্তীতে সাহিত্যজগতে ও বোধিবৃত্তে যিনি পরিচিত হবেন শুধুই অমিয় চক্রবর্তী নামে। মননশীল বৈদগ্ধ্যের আর মরমিয়া প্রজ্ঞার এই যশস্বী অধ্যাপক একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও নিবিষ্ট সমাজদর্শক — বাঙালির মেধাচর্চার এক চির-উজ্জ্বল অভিজ্ঞান। তাঁর পারিবারিক প্রেক্ষাপট চিনিয়ে দেয় তাঁর শিকড়। পিতা আসামের গৌরীপুর এস্টেটের দেওয়ান, মাতা শিক্ষিতা ও ধর্মজ্ঞা — ‘বঙ্গনারী’ ছদ্মনামে নিয়মিত লিখেছেন নারীর অধিকার বিষয়ক প্রবন্ধ। অমিয় চক্রবর্তীর প্রাথমিক শিক্ষা গৌরীপুরে। পরে কলকাতার হেয়ার স্কুল ও হাজারিবাগের একটি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্য, দর্শন ও উদ্ভিদবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক।

মাত্র কুড়ি বছর বয়সে, ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে বিশ্বভারতীতে যোগ দিলেন ছাত্র হিসেবে। ধাপে-ধাপে বিশ্বভারতীর শিক্ষক এবং রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব। এর-ই মাঝে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এমএ ডিগ্রি লাভ।

রবীন্দ্রনাথ তার ইউরোপ ও আমেরিকা ভ্রমণকালে (১৯৩০) সঙ্গী করছেন অমিয় চক্রবর্তীকে, পরে পারস্য ও মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমণেও (১৯৩২)। অথচ, মনে মনে বন্ধনহীন এই মানুষটি পদত্যাগ করে রবীন্দ্রসান্নিধ্য থেকে দূরে সরে গেলেন। কারণ— “মহাপুরুষের ছত্রতলে বিরাজ করার মধ্যে একটা অলীকতা আছে — ওইরকম আশ্রয় মানুষের আত্মার পক্ষে ক্ষতিকর যদিও প্রেরণার দিক দিয়ে যা পেয়েছি তাও অসীম।”

অমিয় বিশ্বভারতী ছেড়ে চললেন ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে। গবেষণা করলেন ভারতবর্ষের নানা ধর্ম-আন্দোলনের বিষয়ে। ডিফিল্ উপাধি তো পেলেনই, তার সঙ্গে প্রথম এশিয়াবাসী হিসাবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সিনিয়র রিসার্চ ফেলো’ মনোনীত হলেন। এরই মাঝে জীবনসাথী হিসাবে গ্রহণ করলেন ডেনমার্কের কন্যা হিওর্ডিস সিগোর-কে, রবীন্দ্রনাথ যার নাম রাখবেন হৈমন্তী (হিমের দেশের মেয়ে)।

ইতোমধ্যে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও একবার নিবিড় হয়েছে (১৯৩৩–১৯৪১)। ইউরোপীয় আধুনিক সাহিত্য ও চিন্তাধারার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটাচ্ছেন তিনি। “তাঁর ( হাক্সলি ) ভাষায় তাঁর ইঙ্গিতে কোথাও বড়োকে বিদ্রূপ করা হয়নি। এই বড়োই তো চিরকালের বড়ো। (রবীন্দ্রনাথের পত্র অমিয়চন্দ্রকে)।

দেশে ফিরে এসে (১৯৩৭) লাহোর ক্রিশ্চিয়ান কলেজে অধ্যাপনা শুরু করলেন। আরও একবছর পরে প্রকাশিত হবে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ, “খসড়া”— যা পড়ে মুগ্ধ বুদ্ধদেব বসু লিখবেন: “বিস্ময়কর বই। খুলে পড়তে বসলে পাতায় পাতায় মন চমকে ওঠে। … উগ্র রকমের আধুনিক। … বিস্মিত মন সানন্দে স্বীকার করে যে এখানে প্রকৃত কবিত্বশক্তির পরিচয় পেলুম।”

পরের বছরেই (১৯৩৯) বেরোচ্ছে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ, “এক মুঠো”— যা প্রকাশের পর “নবযুগের কাব্য” শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন: “আমি আনন্দ পেয়েছি অমিয়চন্দ্রের কাব্যে তাঁর স্বকীয় স্বাতন্ত্র্যে। এই স্বাতন্ত্র্য সংকীর্ণ পরিধি নিয়ে নয়। এ নয় কেবল যৌন রসভোগের উদ্বেলতা, এ নয় আঙ্গিকের বিস্ফোরণে ভাষাকে উলট পালট করে দেওয়া, অনুভূতির বিচিত্র সূক্ষ্ম রহস্য আছে এর মধ্যে — বৃহৎ বিশ্বের মধ্যে এর সঞ্চারণ।”

১৯৪০ সাল। অমিয় চক্রবর্তী যোগ দিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যেখানে তিনি অধ্যাপক হিসেবে কাটাবেন আটটি বছর। সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে নিয়োজিত করলেন রবীন্দ্রনাথের আদর্শে এবং গান্ধীজির প্রত্যক্ষ শিক্ষায় সেবা ও কল্যাণব্রতে। ১৯৪০-এর মহামন্বন্তর, ১৯৪২-এ অগাস্ট আন্দোলন, ১৯৪৫-এ হিরোসিমায় পারমাণবিক বোমা-বিস্ফোরণ, ১৯৪১-এ চলে গেছেন পরম মানুষ রবীন্দ্রনাথ। এ-সবকিছুই বয়ে যাচ্ছে অমিয়র ওপর দিয়ে। ছোটোখাটো, নিরীহ, দুর্বলদেহী কবিমানুষটি অকুতোভয়ে মহাত্মার সঙ্গে গেলেন নোয়াখালিতে, বিহারের নরমেধক্ষেত্রে।

১৯৪৮ সাল। আন্তর্জাতিক মননে দীপ্ত অমিয় চক্রবর্তী চললেন মার্কিন মুলুকে, সপরিবারে। অন্তরে মানবমিলন ও বিশ্বশান্তির ভারতমন্ত্র। ওয়াশিংটনে হাওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য ও ধর্মতত্বের অধ্যাপক (১৯৪৮–১৯৫০), ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং ফেলো (১৯৫০), বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (১৯৫৩–১৯৬৫) ও এমেরিটাস প্রফেসর। একেবারে শেষে স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ নিউইয়র্কের একটি কলেজের অধ্যাপক। এই কথাগুলো বলে নিতে হল এই কারণে যে অমিয় চক্রবর্তীর এই আবিশ্ব অভিজ্ঞতার মাটিটিকে না চিনলে তাঁর কবিতার শিরা-উপশিরাগুলোকে সনাক্ত করা যাবে না। আবার ফিরে যাওয়া যাক কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ “খসড়া”-র অন্তঃপুরে।

Spread the love

2 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *