জৈব বিবর্তনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ডারউইন সাহেব এক জায়গায় উল্লেখ করেছিলেন অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম। সেখানে প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, বন্যা, খরা, ঝড়-ঝঞ্ঝা, বালিঝড়, ভূমিকম্প, অগ্ন্যুৎপাত প্রভৃতি প্রতিকূল পরিবেশ জীবের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। সুতরাং, জীবকে অস্তিত্ব বজায় রাখবার জন্য প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, উত্তর ও মধ্য-আমেরিকায় কোয়েল পাখি প্রচণ্ড ঠান্ডা ও তুষারপাতের ফলেই লুপ্ত হয়েছে। ডারউইন আরও অনেক ব্যাখ্যার মধ্যে উচ্চারণ করেছেন অভিযোজনের কথা। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, ছোটো লোমওয়ালা কুকুর গরমের দেশে বেঁচে থাকবার উপযুক্ত হলেও তা শীতপ্রধান দেশে বেঁচে থাকবার অযোগ্য।
যদিও ডারউইনের ব্যাখ্যার প্রেক্ষিতের সঙ্গে সাধনার প্রেক্ষিতের মিল নেই তবু টিকে থাকবার জন্য যে লড়াই করতে হয়, যে প্রতিকূলতার সামনা-সামনি প্রতি মুহূর্তে হতে হয়, তাকে তো অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম না বলে কোনো উপায় থাকে না! সাধনা নিয়ে কিছু বলতে গেলে আমার মনের চোখ যে শব্দটির কাছে আটকে যায় তা হল সাধ। আর শুধু সাধ থাকলেই কি হবে! না, সাধকে যে বহন করবে, লালন করবে, পালন করবে, সে-ই তো সাধক! তাকে ছাড়া সাধনা অসম্পূর্ণ।
সাধ্য তখনই সহায়ক হয়ে ওঠে যখন সাধ ঘন হয়। তারপর তীব্র আঠালো থেকে ‘তর’ ও ‘তম’ ছাড়িয়ে এক্কেবারে ক্ষীর! অর্থাৎ আকাঙ্ক্ষিত ক্ষীরের বাটি স্বপ্নে দানা বাঁধে। আর সে রস ছুঁয়ে ছুঁয়ে নিজেকে সিক্ত রাখা। আমার চাওয়ার কাছে আমি কতটা সৎ, কতটা নতজানু সেটা বুঝে নেবার জন্য কিছুটা সময় অবশ্যই দেওয়া দরকার। আমি অভিযোজিত হতে পারব কিনা তার জন্য কষ্টিপাথরে ঘষে নেওয়া দরকার সাধনার সূচনা পর্বে। নিজেকে খুঁড়ে নিয়ে খাদ আছে কিনা দেখে নেওয়াটা জরুরি বলে মনে হয়। তা না হলে, মাঝপথে ল্যাজে গোবরে হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। হ্যাঁ, এ-ও ঠিক যে, অভীষ্ট লক্ষ্যে যাওয়ার পথে প্রতিবন্ধকতা আসবেই! দৃঢ়চেতা মন পারে লক্ষ্য ভেদ করতে।
বিচিত্রসাধ কবিতায় রবিকবি ফেরিওয়ালা, ফুলবাগানের মালী, পাহারাওলা হতে চেয়েছেন। আমরা তো সবাই কম বেশি জানি রবীন্দ্রনাথের চলার পথ। মসৃণ ছিল কি খুব? না, জীবনে প্রচুর সামাজিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে ওঁকে। তবেই না ফুলবাগানের মালী হলেন! আর ফেরিওয়ালার মতো ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, আমাদের জীবনে আলো অন্ধকারের ছোঁয়া দিতে দিতে ভিতরকার মাটি খুবলে খুবলে একেবারে অন্তরাত্মার মুখোমুখি দাঁড়ালেন, আর আমরাও দাঁড়িয়ে পড়লাম। জীবনের এমন কোনো মুহূর্ত বা পর্ব বাকি নেই যে জায়গাটায় তাঁর লেখনী আমাদের ছুঁয়ে থাকেনি।
আমি ভাবি ঘোড়া হয়ে মাঠ হবো পার,
কভু ভাবি মাছ হয়ে কাটিব সাঁতার।
কভু ভাবি পাখী হয়ে উড়িব গগনে।
কখোনো হবে না সে কি ভাবি যাহা মনে?
—কত জিজ্ঞাসা ইচ্ছে আর ইচ্ছেপুরণের মাঝখানে! মাথার ভিতরে মনের ভিতরে পোকার মতো কামড়ে ধরা প্রশ্নগুলো যন্ত্রণার প্রাবল্য না ছড়ালে সাধ কখনোই সাধনার স্তরে পৌঁছতে পারে না। আমাদের ‘প্রতিদিনের রবীন্দ্রনাথ’ তা প্রমাণ করে গেছেন।
সাধের এই জোরের উপরেই নির্ভর করে সাধ্য। প্রতি মুহূর্তে সাধ আর সাধ্যের মধ্যে চলে সংঘাত। চিত্তের একাগ্রতা আর মননের নিমগ্নতাই এক সময় সাধ্যকে অতিক্রম করে ফেলে। সাধ আর সাধ্যের মধ্যে লড়াই একজন মানুষকে সাধক করে তোলে। আর পথজুড়ে নানান আকৃতির বিছানো পাথর মাড়িয়ে চলার যে প্রক্রিয়া, তাই সাধনা। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে তা সে যে কাজই হোক, সাধনা ছাড়া কোনো গতি নেই। আমার এক অন্যতম প্রিয় কবি রামপ্রসাদ সেন। যাকে আমরা সাধক কবি বলে ডাকি। ধর্মসাধনার উপলব্ধি ব্যক্ত হয়েছে রামপ্রসাদের গান কবিতায়। শুধু পূজা অর্চনার জন্য আমি ওঁকে সাধক বলি না! বলি তাঁর সাধ নিয়ে, সাধের কেন্দ্রবিন্দু নিয়ে। অষ্টাদশ শতকের এই কবি সহজিয়া ভাষায় শাক্তগান রচনা করে ভারতীয় ভক্তিসাহিত্যের ধারায় নজির তৈরি করেছেন। ধর্ম একটি বিশ্বাসের নাম, যেখানে ভারতীয় সংস্কৃতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস যাই হোক না কেন, আমি ইচ্ছে আর ইচ্ছেপূরণের মাঝখানের ফাঁকা জায়গাটির ভরাটের পদ্ধতিগত গভীরতায় দৃষ্টিপাত করছি। প্রবল প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও বিষয়ের কাজে মন বসাতে পারেননি রামপ্রসাদ। অভিযোজিত হতে পারেননি! ফিরে এসেছেন ইচ্ছে ঈশ্বরের কাছে। আমরা পেলাম সাধক এবং কবিকে। বাঙালির সাহিত্যচর্চা ও ধর্মসাধনা এই দুয়ের সঙ্গেই তাঁর নিবিড় যোগ। তত্ত্বের সাথে ভাবের, জ্ঞানের সাথে ভক্তির, সংগ্রামের সাথে সমর্পণের বিরল সমন্বয় রামপ্রসাদের গানে। আরও একজন মহান ব্যক্তিত্ব শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও ধারণা আমাদের যেমন মুগ্ধ করে, তেমন করে বিচলিত, পাশাপাশি থিতুও করে। রামপ্রসাদ বিষয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, গানে রামপ্রসাদ সিদ্ধ।
দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের পুরোহিত রামকুমারের মৃত্যু ঘটলে ১৮৫৬ খৃষ্টাব্দে গদাধর ওই মন্দিরের পুরোহিত নিযুক্ত হন, এ-কথা সবার জানা। কিন্তু তন্ত্র-মন্ত্র আর নিয়ম অনুশাসনের উপরে উঠে মাতৃভাবে মায়ের পুজো করে যে আত্মচৈতন্য অনুভব করেন, ঠাকুরের এই দিকটা আমাকে ভীষণ টানে। জীবনের চলা যেভাবকেই সঙ্গ দিক না কেন তাকে যদি আষ্টেপৃষ্ঠে আপন করে না নেওয়া যায়, তবে তা কখনোই নিজের হয়ে ওঠে না। প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গিতে শিক্ষিত না হয়েও শিক্ষিতমহলে সম্ভ্রম আদায় করেছেন। শাক্তমতে ও তন্ত্রমতে সাধনায় সিদ্ধ হন। আমরা ওঁকে যোগসাধক ও দার্শনিক জ্ঞানে সমীহ করি। ইসলাম ও খ্রিস্টীয় মতে সাধনা রামকৃষ্ণকে ‘যত মত তত পথ’ এই উপলব্ধির জগতে উন্নীত করে। আর ওঁর বোধ! শুধু আমি নই, আপামর জগৎবাসী মর্মে মর্মে অনুভব করেন জীবনের প্রতি মুহূর্তে। আর এই পথই আমাদের নিজস্ব পথ তৈরি করতে সহায়ক হয়ে ওঠে। আমরা অনুপ্রাণিত হই। ভেতর থেকে শক্তি জেগে ওঠে। আবার কখনো নিজেরাই নিজেদের জাগিয়ে তুলি। আমাদের সাধনার পথও একটু একটু করে প্রশস্ত হয়।
আজ থেকে ২৫-২৬ বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে ঠিক কবে যে লেখা শুরু করেছিলাম তা আজ আর মনে নেই। আর সত্যিই ঠিক সেভাবে লেখা শুরুর একটি দিন নির্ধারণ করা যায় কিনা জানি না তাও! বেশ কিছু বইপত্র থাকলেও আদৌ তা নিজস্ব ভাষা পেয়েছে কিনা বলা মুশকিল। যদি কিছু বলার থাকে বলবে সময়। তবু! তবু বলব লেখা পড়ার সাথেই নিত্য বসবাস। আর জীবন যোগায় সে রসদ। সেই অভিজ্ঞতার রস যে প্রসাদ হয়ে ওঠে তা তো অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই। প্রচুর অবজ্ঞা অপমান অনাহারের পাশাপাশি প্রশংসা প্রশ্রয়—এ-ও কি সাধনার আশ্রয় নয়! তবে যে পথ আমার, সে পথের শেষ কোথায়! কোনো সিদ্ধিলাভ হয় কি! আমার স্থির বিশ্বাস, হয় না। জীবনরস তা মিঠে বা তেতো যাই হোক, সেটা নিংড়ে নিংড়ে অন্তরাত্মার ভেতর ধারণ করে লেখনী নির্ভর থাকাই আমার কাছে সাধনা। এই লেখার পিপাসার স্থায়িত্ব আমার কাছে সাধনা। একটি লেখার পর অতৃপ্তিই আরেকটি লেখার ইচ্ছের কাছে দাঁড় করায়। দাঁড়িয়ে থাকাটাই আমার কাছে সাধনা!
অবশ্যই জীবনের মসৃণ কর্কশ পাথরের ইতি-নেতিগুলোই আরও বেশি সাধনামুখী তথা কর্মমুখী করে। বাধা আসে বারংবার। হাহাকার প্রবঞ্চনা মুহুর্মুহু! যন্ত্রণা সইতে হয় শুধু ওই নিজের একাটুকুকে! কারণ এ-পথ একার। এ-পথ নির্জন। চোখেমুখে অন্ধকার আসে আবার হাসেও! পথের পাশে অন্য পথও সবুজ রুমাল ওড়ায়! অস্থির হয়েও থিতু হতে হয়। প্রিয় কবি বলেন, “একা যদি না পারিস মা, রামপ্রসাদকে সঙ্গে নে না…”
সঙ্গী হয়ে যাই বারবার, নিজের অজান্তেই কখন যেন কবিতার। নানান রূপে, নানান রঙে, আবার বর্ণহীনতায় আমার পথ চলা কবিতার সাথে। একেই আমি সাধনা বলি। আর অবিচলিতভাবে কঠিন, তরল, ও গ্যাসীয় হই ঠিক নিজের ধর্ম মেনে। কর্মে আনুগত্য রেখে বরফজল বাষ্প হয়ে রূপ বদলাই সময়ের সাথে! একেও আমি সাধনা বলি। আর বলেই যাব।
খুব ভালো লাগলো এই লেখাটি