Menu Close

নীল সুরের রামধনু রং
শবরী রায়

বই হবে ভেবে কেউ-ই বোধ হয় লেখা শুরু করে না৷ কিন্তু এক সময় তা হয়ে যায়৷ একটা হয়ে যাওয়া বই লেখককে পেছন থেকে একটা জোর ধাক্কা মেরে ওই জায়গাটা থেকে সরিয়ে দেয়৷ আমরা খাদে পড়ি, না নদীতে… কিংবা পথ হারিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ি৷ যাই-ই হোক না কেন, সেই আমি-র কাছে আর ফিরে যাই না৷ আমি তো যাই না অন্তত৷ খুলেও দেখি না৷ এমনকী মুদ্রণপ্রমাদ হল কিনা, তাও দেখার চেষ্টা করি না৷ সত্যি বলতে কী, আমার ভয় করে৷ আমি ভীতু মানুষ৷ সন্তানের কাছে মা কি কিছু আশা করে?

স্বাভাবিকভাবে করে না বোধ হয়৷ আর আমি তেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মা নই৷ বাচ্চাকে দু-বেলা ডাল-রুটি খাইয়ে, মানুষ হোস—বাবা-বাছা করেই পলায়ন৷ বাস্তব স্বভাব কেউ বদলাতে পারে না৷ যাই হোক, আমার দুটো বই নিয়ে লেখার কথা৷ সব বইয়ের ধারণ সময় আর প্রসব সময় মনে পড়ছিল কাল৷ কিন্তু কোনটা যে লিখব, বুঝতে পারছিলাম না৷ গতকাল বাইশে শ্রাবণ ছিল৷ কত পোস্ট দেখছিলাম৷ আমারও রবীন্দ্রনাথ আছেন৷ আমি তাঁকে বাইরে বের করি না৷ তাঁকে অতিক্রম করার ভাবনা তো দূর৷ প্রয়োজন পড়লে তাঁর গানের দ্বারস্থ হই৷ যে বইটার কথা বলব, তার নাম “এসরাজে বেজেছে নীল সুর”৷ কী বড়ো নাম, তাই না? মলাট হয়ে যাওয়ার পর এক বিখ্যাত কবি বলেছিলেন ‘নীল সুর’ শব্দটা বাদ দিতে৷ নামের ক্ষেত্রে আমি বেশ খুঁতখুঁতে৷ অন্যদের জিজ্ঞেস করি৷ কিন্তু শেষমেশ ওই নামটাই রয়ে গেল; ‘নীল সুর’ বাদ দেওয়া হল না আর৷

এই বই তৈরির একটা মজার গল্প আছে৷ আমি সে-সময় মুম্বাইতে থাকি৷ নাক ডুবিয়ে সংসার করছি৷ ছেলে একদিন বাবাকে জিজ্ঞেস করল, ধামাচাপা কী? বাবা বলল, ধামা একধরনের ঝুরি৷ যা দিয়ে কিছু ঢেকে রাখা হয়৷ ধর কোনো বিষাক্ত সাপ৷ যেমন তোর মা-কে আমরা ঢেকে রেখেছি৷ সঙ্গে হাসি৷ যদিও ধামাচাপা মানে তা নয়৷ এসব ঠাট্টা৷ আমি অবশ্য ঠাট্টা বুঝি না, আমি ইদানিং জেনেছি৷

আমার একটা গান জীবন ছিল। পড়াশুনো এবং লেখা নিয়ে গোপনে কাটাকুটি করার ওপরের মলাটে। শৈশবে কমপক্ষে ঘণ্টা চারেকের রেওয়াজ ছিল বাঁধা। আমি ওই কসরত আর কালোয়াতির পেছনে নিজেকে লুকিয়ে রাখতাম। টোটাল ইনট্রোভার্টেড বলতে যা বোঝায়। তবু, বহু গুণী ও নামী সঙ্গীতগুরুর শিক্ষা ও সাহচর্য পেয়েছিলাম। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসংগীত আকাদেমি এবং রবীন্দ্রসদনের ট্যালেন্ট হান্ট থেকে খুঁজে বের করা হয়েছিল শবরী দাশগুপ্তকে। তার আগে থেকেই গান গাই রেডিও-তে। আকাশবাণীর ঠান্ডা ঘর, সহ যন্ত্রশিল্পীদের ওই ছোটো মেয়েটার প্রতি অশেষ স্নেহ, আমাকে ঝর্ণার জলে স্নানের আনন্দ দিত। বিয়ের পর সাংসারিক প্রয়োজনে ধীরে ধীরে ছেড়ে দিলাম সুরের সাধ। আমার শিক্ষক, শিক্ষিকা, আত্মীয়, শুভাকাঙ্ক্ষীরা কেউ আমার গান বন্ধ হয়ে যাওয়া নিয়ে প্রকৃত বা অপ্রয়োজনীয় হা-হুতাশ করলে আমি তৎক্ষনাৎ জবাব দিতাম, “আমার প্রতিভা তেমন কিছু ছিল না নিশ্চয়ই৷” ধামার তলায়, বিশ্বাস করুন, ফোঁস-ফাঁস-ও করতাম না আমি। আমি—এই বিষাক্ত কালসাপ ৷ ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন অতি বিষাক্তরাও বিয়ের পর ঢোঁরা ঢ্যামনা। বক্তব্যটা এমনই কিছু ছিল। তবে সঠিক উদ্ধৃতির জন্য বই দেখতে হবে। অবশ্য সেই বই এই শহরের আলমারিতে নেই। যাই হোক, তখন মাঝে মাঝে ছবি আঁকতাম৷ আমাদের ঠিক নীচের তলায় এক মারাঠি ভদ্রমহিলা থাকতেন৷ তাঁর নাম মিসেস শামল নিকম৷ মিসেস নিকমের সঙ্গে কোনো কারণে আমার বেশ ভাব হল৷ কারণটা কিছুতেই খুঁজে পাচ্ছিলাম না৷ খুব ডাউন-টু-আর্থ৷ সাধারণ জীবন, যাপন৷ যতটুকু না হলেই নয়, তার বাইরে কিচ্ছু কেনেন না৷ একদিন বিকেলে ওঁর বানানো ঘন আদা-চা খেতে খেতে একটা ছোট্ট পেইন্টিং-এর দিকে নজর গেল৷ কোণায় টাঙানো৷ সহজে চোখে পড়ে না৷ আমি তখন ওঁর কাছে খুবই স্বচ্ছন্দ৷ এমনকী ওর বেড়ালমণি যে অন্য কারো সামনে মুখ দেখায় না, আমি এলে পাশে বসে থাকে৷ আমাকে পাত্তা দেয় না৷ গল্প শোনে৷ জিজ্ঞেস করলাম, এটা কার আঁকা? বললেন “আমার৷” ছবি দেখা আমার প্যাশন৷ আমি ব্রাশের স্ট্রোক চিনি৷ আমি বললাম, “এই একটাই?” বললেন, “না, আরও ছিল৷” “এখন আঁকেন না?” বললেন, “না৷” পড়াশোনার কথা উঠল একদিন৷ জে জে কলেজ অফ আর্টস থেকেই শিক্ষা৷ মনের মিল ছিলই৷ আমরা পরস্পরকে আঁকড়ে ধরলাম৷ বললাম, “প্লিজ, আমাকে আঁকা শেখাও৷ আমি টাকা দিয়ে শিখব৷” রাজি নন কিছুতেই৷ আমিই জবরদস্তি—আমার ছেলে, আর দুটো মেয়েকে হাজির করলাম৷ বললাম, মাসে এক দু-দিন আসব আমি৷ আমার আলাদা সময় চাই না৷ বাচ্চাদের সঙ্গেই বসব৷

তুলির টান দিতে দিতে গল্প হয়৷ মুম্বাইয়ের বর্ষা৷ আমি এলে চা হয়৷ আমিও কিছু বানিয়ে নিয়ে যাই৷ তার আগের বর্ষায় আমার প্রথম বই বৃষ্টির তাঁবুর ভেতর লিখেছি৷ পয়লা বৈশাখে বেরিয়েছে “শরীরের বাতিঘর”৷ জয় গোস্বামী ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন৷ কবি শ্যামলকান্তি দাশ বইটা পড়ে আমার ফোন নাম্বার খুঁজে ফোন করেছেন৷ ধামার নীচে আমি আবার শ্বাস ফেলছি৷ প্রচণ্ড বৃষ্টির বিকেলে মিসেস নিকম জিজ্ঞেস করলেন রবীন্দ্রনাথের কথা৷ কিছুই পড়েননি৷ শুধু নোবেল প্রাইজ পাওয়ার কথা জানেন৷ আমাকে বললেন, রবীন্দ্রনাথের কবিতা পড়তে চান৷ যদিও মিসেস নিকম-এর দাবি, কবিতা উনি বোঝেন না৷

আমি সে-সময় সপ্তাহে তিনদিন ক্রসওয়ার্ডে পড়তে যেতাম৷ সকালে সবাই বেরিয়ে গেলে, সব কাজ সেরে সাড়ে দশটায় বেরোতাম৷ দু-টোর মধ্যে ফিরে আসতে হত, ছেলে ফেরার আগে৷ বাংলা বই মুম্বাইতে পাওয়া যায় না৷ ইংরেজি বইয়ের দাম অনেক। প্রতি মাসে বই কেনা অসম্ভব৷ তাই একটা ডায়েরি আর পেন রাখতাম৷ পড়তাম, আর মাস গেলে একটা বই কিনতাম৷ যেটা সংগ্রহে রাখতে হবে মনে হত৷ এরপর খুঁজে পেতে একদিন Song Offerings পেয়ে গেলাম৷ পাশে বাংলা কবিতা এবং গানও আছে৷ বইটা আমি নতুন করে আবিষ্কার করলাম যেন৷ পড়তে পড়তে অন্যভাবে ভাবছিলাম৷ বিশ্বের দরবারে একজন বিখ্যাত কবির স্পেসিমেন কবিতা পৌঁছোনোর জন্য যে সম্পাদনা দরকার, তার সবটা এই বইতে আছে৷ একটা দীর্ঘ বাংলা কবিতাকে প্রয়োজনে দশ বারো লাইন ইংরেজি করা হয়েছে৷ নিজে পড়ছিলাম আর মিসেস নিকমকে পড়ে শোনাচ্ছিলাম৷ আমার হিন্দিতে উপচে যাচ্ছিল আবেগ৷ এক সন্ধ্যায় গান গেয়ে উঠলাম… মেঘের পরে মেঘ জমেছে… কথা না বুঝলেও মিসেস নিকমের চোখ ভেজা। ওঁকে ইংরেজি কবিতাটা পড়ে শোনালাম৷ ঘরে ফিরে রাতে লিখলাম “মেঘ বন্দিশ”৷ এরপর স্রোতের মতো লেখা শুরু হল৷ রবীন্দ্রনাথের জননী, আমার জননী৷ ডি পি এস স্কুলের গানের কম্পিটিশনে বিচারক হয়ে গেলাম৷ শিশুদের সারি দেখে লিখলাম৷ রবীন্দ্রনাথের বাংলা প্রেমের কবিতা যেমন ইংরেজিতে He হয়ে গেছে৷ আমিও লুকোতে শিখলাম নিজেকে৷ এই বইটা একটা শেখার যাত্রা৷

প্রতিভাষ-এর কর্ণধার আমার লেখার খবর নিতেন৷ এই লেখাটার কথা বলতেই বললেন পাঠাও৷ আমি ছাপব৷ তখনও পর্যন্ত চল্লিশটা মতো লেখা হয়েছে৷ তাই পাঠালাম৷ ফোন করে বললেন আরো কয়েকটা চাই৷ পারবে৷ হয়ে যাবে৷ পাঠালাম৷ বইয়ের কাজ চলাকালীন কলকাতা গেলাম। প্রকাশকের সঙ্গে দেখা হল৷ তখনও অবধি চারবার প্রুফ দেখা হয়েছে৷ আমার লেখাগুলোর শিরোনামে Song Offerings-এর দু-একটা লাইন৷ তাই বিশেষ সতর্কতা৷ আমাকে বসতে হল, ইংরেজি অংশের ফাইনাল প্রুফ চেক করার জন্য৷

ততক্ষণে আমার ফোন বাজতে শুরু করেছে, সেদিন গঙ্গাবক্ষে বন্ধুদের সঙ্গে সূর্যাস্ত দেখা আর আড্ডার প্ল্যান৷ আমি এসেছি বলে বিশেষ ব্যবস্থা৷ প্রুফ দেখা শেষ হলে, আমি যাই বলতেই আমার জন্য চা এলো৷ ফোন বেজে চলেছে৷ দু-চুমুক দিয়ে আমি পালাতে যাব, প্রকাশক বললেন, “ফোনটা দেখি! নতুন?” আমি বললাম, “না তো, পুরোনো৷” “দেখি একটু,” বলে ফোনটা নিয়ে ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলেন৷ বললেন, “দুটো পাতা সাদা যাচ্ছে৷ এখন লিখে ফেলো, তারপর যাবে৷” বলে আমাকে একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হল৷ সেদিন সম্ভবত সেখানে এখনকার ধানসিঁড়ি প্রকাশনীর শুভ-ও ছিল৷ অসহায় আমি শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে চটি খুলে পায়চারি৷ ওদের বললাম, তোমরা কেউ আমার দিকে তাকিয়ো না৷ তারপর লেখা দুটো শেষ করে যখন ফোন ফেরত পেলাম, ততক্ষণে অন্ধকার হয়ে গেছে৷ বেড়ানোর দফারফা৷ বন্ধুর রাগ৷ শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেলাম৷ সেখানে অবশ্য তাড়াতাড়ি ফিরলাম বলে খুশি৷

বইটা হল৷ বইমেলায় গেলাম শেষের দু-তিন দিন৷ এয়ারপোর্ট থেকে সোজা বইমেলায়৷ খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক “এসরাজে বেজেছে নীল সুর” কিনবেন বলে কাউন্টারে রেখে অন্য কোনো বই আনতে গেছেন৷ আমি সেই ফাঁকে বইটা হাতে নিয়ে শেষ কবিতা দুটো দেখছিলাম, যেগুলোর কোনো কপি আমার কাছে নেই৷ হঠাৎ ভদ্রলোক বইটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে বললেন, “এটা আমার৷ আপনি অন্য একটা নিন৷” ভঙ্গি রাগত৷ কাউন্টারের ছেলেগুলো ঘটনা দেখে, আমার ভ্যাবাচ্যাকা মুখ দেখে হাসছিল৷ রশিদ কাটতে কাটতে ওরা ভদ্রলোককে বলল, বইটা যার হাত থেকে কেড়ে নিলেন, উনিই এই বইটা লিখেছেন৷ তারপর যা হয়, লজ্জিত ভদ্রলোক আমার সামনে এলেন৷ ততক্ষণে আমার একটা ভালো লাগা তৈরি হল৷ লেখককে না চিনলেও চলে৷ এভাবেই একটু একটু করে আমার বিশ্বাস ফিরে আসছিল৷ আর লুকোনোর জায়গা গভীর হয়ে উঠছিল৷

যদিও একজন এই বইয়ের মন্দ আলোচনা করেছিলেন৷ আমি নাকি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে টক্কর দিতে গেছি, এমন সাহস আমার! তিনি যে আমার কবিতাগুলো তেমন বোঝেননি, সেটা আমি বুঝে গিয়েছিলাম৷ যদিও একটি পত্রিকা সেই আলোচনা ছেপেছিল৷ যিনি এটা লিখেছিলেন, তিনি ইদানিং বলেন তিনি নাকি আমার লেখার ভক্ত। যাই হোক “এসরাজে বেজেছে নীল সুর” আমার তৃতীয় বই৷ বেজেছে যখন, ইথার তরঙ্গে কোথাও-না-কোথাও রইলো৷ আমার যাপনের রামধনু সিঁড়ি৷


শবরী রায়-এর প্রকাশিত গ্রন্থ

Spread the love

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *