রাত ফুরোলেই অনেক মানুষ দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। গতরাতের আঁধারোপম মায়া ক্রমশ কেটে যায় তার চোখ থেকে, অধর থেকে, ব্যবহারিক প্রয়োগ আর অধিকারবোধ থেকে। সে ক্রমশ গড়াতে থাকে দৈনন্দিনতায়। প্রাসঙ্গিকতার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে সে ক্রমশ। আমার দিনগুলো সব মরীচিকাময়। রাতগুলো অন্ধকারের দ্যোতনা। আমার মাথার ভেতর দৃশ্যগুলো সব শব্দ হয়ে যায়। অদৃশ্যগুলোও শব্দ হয়ে যায়। কল্পনার যে বাস্তব, আর বাস্তবের কল্পনা — আমি এই দুয়ের টানাপোড়েনের মধ্যে পাক খাই। কত কত পথ আমাকে কোনো এক গন্তব্যের দিকে টানে, আর আমি হাত ছাড়িয়ে পেরিয়ে চলে যাই। আশ্রয়ের একটা নিশ্চিত অবয়ব চোখের একেবারে অন্তঃস্থলে ঘাপটি মেরে আছে যেখানে আমার আন্তরিক বিশ্রামগুলো সব মিউট করে রাখা। দূর থেকে দেখে যাকে নীড় বলে মনে হয়, সে আসলে আমারই মস্তিষ্কের ভেতর তৈরি হতে থাকা একটা কাল্পনিক প্রবৃত্তিমাত্র, আবেগমথিত প্রহেলিকা। তার কাছে পৌঁছোতে ইচ্ছে করে খুব, কিন্তু কাছে গেলেই সে যেন চারপাশের আর বাকি দৃশ্যুগুলোর ভাঁজে ভাঁজে নিজেকে আড়াল করেই রেখে দেয়। আবেগের দড়িটায় বড্ড টান লেগে রয়েছে এখনও। এখনও কিছু কিছু অতীত স্মৃতির ভেতরে গিঁট লেগে জট পাকিয়ে রয়েছে। একেকটা প্রশ্বাসের যেন কতযুগ বয়স — বড়ো প্রাচীন বোধ হয়! কারও কারও অপ্রতিরোধ্য চাহনির দিকে তাকালে মনে হয়, যেন কয়েক পশলা নীচেই আমাদের গতজন্মগুলো ইনিয়ে-বিনিয়ে রয়েছে গোধূলিপ্রান্তের সেই ছায়াটির দিকে মুখ ফিরিয়ে। তাদের চোখ দিয়ে, গাল বেয়ে নেমে আসছে মল্লার, বেহাগ, বাগেশ্রী, ভৈরব, মালকোষ, হিন্দোল…
আমি নিজের মুখোমুখি এসে দাঁড়াই। নিজের ছায়াটিকে স্পর্শ করে থাকি। দেখি, গোধূলিপ্রান্তে ঝিম ধরে আছে, আর, আলোর ভেতর থেকে জন্ম নিচ্ছে অন্ধকারের ফসিল!
এইসব অন্ধকার হাতড়ে হাতড়ে আমার যখন যাবতীয় স্তব্ধতাগুলো ফিনকি দিয়ে ওঠে ভেতরে, আমি তখন কবিতার কাছে এসে দাঁড়াই, থামি। যে-কোনো কবিতার কাছেই। যে কারোর কবিতার কাছে। মুক্তির কাছে। বিশ্রামের কাছে। একটা অমোঘ আশ্রয়ের কাছে এসে, হাঁটু মুড়ে বসে পড়ি, জিরিয়ে নিই খানিক।
যে-কোনো কবিতা নয়… প্রকৃতির মধ্যে, জীবনের ভেতর চুঁইয়ে পড়া অন্ধকারগুলো যে কবিতায় ভাষার ছোঁয়া পেয়ে আলো হয়ে ফুটে ওঠে — সেই কবিতা! সে-সব কবিতা আমাকে ভেতর থেকে টান দেয়। নাজেহাল করে। কিন্তু এ তো একপ্রকার অস্থিরতা! তাহলে যে বললাম ‘আশ্রয়’, তাহলে যে ‘মুক্তি’ বললাম, ‘বিশ্রাম’ বললাম! বলেছি। ঠিকই বলেছি। এই অস্থিরতার ভেতরে নাকানিচোবানি না খেলে এ-শান্তি আসে না আমার। ‘মুক্তি’ বা ‘বিশ্রাম’গুলো আসে না কিছুতেই। এই সব অস্থিরতার কোনো নির্দিষ্ট সমীকরণ নেই, ব্যাকরণ নেই, বানান নেই, উচ্চারণ নেই! এই সব অস্থিরতার স্তব্ধতাগুলো আর চিৎকারগুলো সব সমানুপাতিক, সমরেখ, সমকক্ষ ও সমকালীন।
শীতের সকালে আলস্যের আঁজলা ভর্তি অনিশ্চয়তায় কাঁপতে কাঁপতে একটি বইয়ের মলাটবন্দি অক্ষরগুলোর ভেতর নামি, আর দেখি, একটা নতুন দিগন্ত, একটা অতলস্পর্শী আলো, খোলা হাওয়া, অফুরান ধানক্ষেত, মাড়াইকল, আস্তাবল, ঘোড়া, নদী, নৌকো আর জীবন আর মৃত্যু সমেত একটা শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য-যৌবন-বার্ধক্য সব আমার দিকে ছুটে আসছে। একনাগাড়ে। যাকে আমি সরাতে পারছি না। যাকে আমি সরাতে চাইছি না আর। জীবনবোধের চূড়ান্ত আর প্রাণশক্তির আঁতুড়ঘর এই লেখকের কবিতাগুলো! আজকের তারিখে, পৃথিবীর একেবারে অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা একজন বয়স্ক বা প্রৌঢ়ের চিন্তাচেতনার সংযোগ কীভাবে একেবারে ভিন্ন প্রান্তের একজন তরুণ ও আনকোরা ব্যক্তির সাথে ঘটে যেতে পারে! আশ্চর্য হই! বিস্ময় এসে স্বয়ং অবাক করে দিয়ে গেল যেন! তার কবিতার পরতে পরতে যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতামালা, খোদাই করে রাখা আনন্দের সংকলন আর ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়া বেদনাসমগ্র। তার কবিতার ভাষা ও প্রেক্ষাপট একেবারে স্বতন্ত্র ও নির্ভেজাল। তিনি অন্তত বানিয়ে লেখেননি কিছু। যাপনের প্রত্যক্ষগুলোকে শিল্পিত করে অক্ষরে অক্ষরে স্থাপন করেছেন। সৃষ্টিকে নির্মাণের পারদর্শিতা দিয়ে গড়ে তুলেছেন চিরন্তন কিছু একটা। যা এক অভূতপূর্ব শিল্পকর্ম নিঃসন্দেহে।
রবার্ট ব্লাই একজন সত্যিকারের কবি, বিশুদ্ধ অক্ষরসাধক, সফল প্রাবন্ধিক, সাহিত্যকর্মী এবং ‘মাইথোপোয়েটিক মেনস মুভমেন্ট’-এর প্রাণপুরুষ ও ‘ডিপ ইমেজ পোয়েট্রি’-র মতো সাহিত্য আন্দোলনের অন্যতম প্রধান এক কারিগর। তাঁর অভিজ্ঞতার ভেতরের কাঠিন্যগুলোও শিল্পগুণের সামঞ্জস্যে কোমল হয়ে উচ্চারিত হয়েছে এই বইয়ের কবিতায়। এই আমেরিকান কবি ১৯২৬ সালের ২৩ ডিসেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটাতে জন্মগ্রহণ করেন। নরওয়েজিয়ান বংশোদ্ভূত জ্যাকব ব্লাই এবং অ্যালিস ব্লাই-এর সন্তান রবার্ট ব্লাই। ১৯৪৪ সালে স্নাতক হওয়ার পর তিনি বছর দুয়েক মার্কিন নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। মিনেসোটার সেন্ট ওলাফ কলেজে পড়ে বর্ষশেষে স্থানান্তরিত হন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি ডোনাল্ড হল, উইল মরগ্যান, অ্যাড্রিয়েন রিচ, ফ্র্যাঙ্ক ও’ হারা, জন অ্যাশবেরি, হ্যারল্ড ব্রডকে, জর্জ প্লিম্পটন, জন হকস প্রমুখ তৎকালীন স্নাতক লেখকদের দলে যোগ দেন। পরবর্তী কয়েকটি বছর তিনি কাটান নিউইয়র্কে। ১৯৫৪ সালের শুরুতেই, লোয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের লোয়া রাইটার্স ওয়ার্কশপে দু-বছর অতিবাহিত করে, সেখান থেকে ডব্লিউ. ডি. স্নোডগ্রাস, ডোনাল্ড জাস্টিস ও অন্যান্যদের সঙ্গে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন ফাইন আর্টসে। ১৯৫৬ সালে তিনি নরওয়ে ভ্রমণ ও নরওয়েজিয়ান কবিতার ইংরেজি অনুবাদের জন্য ফুলব্রাইট গ্রান্ট লাভ করেন। সেখানে থাকাকালীন তিনি তার আত্মীয়স্বজনদের যেমন খুঁজে পেয়েছেন, তেমনই এমন কয়েকজন বিখ্যাত কবির কাজ সম্পর্কে পরিচিত হন যারা তখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পরিচিত ছিলেন না, যেমন পাবলো নেরুদা, সিজার ভাল্লেজো, আন্তেনিও মাকাদো, গুনার একেলোফ, জর্জ ট্র্যাকল, রুমি, হাফেজ, কবীর, মীরাবাঈ ও হ্যারি মার্টিনসন। রবার্ট ব্লাই তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শুধুমাত্র অনুবাদের জন্য একটি পত্রিকা শুরু করতে বদ্ধপরিকর হন। ‘দি ফিফটিজ’, ‘দি সিক্সটিজ’, ‘দি সেভেনটিজ’-এর সংখ্যাগুলি তার প্রজন্মের লেখকদের সাথে এইসব কবিদের মধ্য থেকে অনেকেরই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। এছাড়াও তিনি আমেরিকান কবিদের বিষয়ে ‘আ রং টার্নিং ইন আমেরিকান পোয়েট্রি’ শীর্ষক প্রবন্ধ লিখে বিপুল সাড়া ফেলেছিলেন। সেখানে তিনি যুক্তি দেন যে, ১৯১৭ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত আমেরিকান কবিতার বেশিরভাগ অংশই ছিল প্রাণহীন ও অন্তর্মুখিতাবিহীন, যা মূলত নৈর্ব্যক্তিকতার প্রতি মনোনিবেশের ফলে ঘটেছিল। রবার্ট ব্লাই সেখানে আরও বলেন যে সেই সময়কালের কবিতাগুলো ছিল একটি আপত্তিজনক ও বিশ্ব সম্পর্কে বৌদ্ধিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা আধুনিকতাবাদীদের দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী আমেরিকান কবিতার নান্দনিকতা সৃষ্টি করেছিল। তার প্রথম দিকের কাব্যসংকলন ‘সাইলেন্স ইন দ্য স্নোয়ি ফিল্ডস’-এর সরল চিত্রকল্পটি পরবর্তী দুই দশকের আমেরিকান কবিতার উপর প্রভাব ফেলেছিল যথেষ্ট। জার্মান ভাষা থেকে রবার্ট ব্লাই-এর অনুবাদ করা রিলকের নির্বাচিত কবিতা ১৯৮১ সালে ‘কমেন্টারি’-তে প্রকাশিত হয়, তারপর অ্যান্তোনিও মাকাদোর নির্বাচিত কবিতার স্প্যানিশ/ইংরেজি অনুবাদ ১৯৮৩ সালে ‘টাইমস এলোন’ প্রকাশ করে। এছাড়াও তিনি ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধিতা করে লেখকদের একত্র করার চেষ্টা করে আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং নেতৃত্ব দেন। ‘দ্য লাইট অ্যারাউন্ড দি বডি’-এর জন্য ‘ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন রবার্ট! ষাটের দশকে তিনি বাঙালি হাঙরিয়ালিস্ট কবিদের প্রচুর অর্থ সাহায্য করেছিলেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে তিনি আমেরিকার প্রতিবাদী কবিদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একজন হয়ে ওঠেন।
১৯৭০ সালে লিখিত কবিতা ‘দ্য টিথ মাদার নেকেড অ্যাটলাস্ট’ প্রতিবাদী কাব্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন যা পরবর্তীকালে রবার্ট ব্লাই-এর ‘স্লিপার্স জয়েনিং হ্যান্ডস’ (১৯৭৩) সংকলনে সংগৃহীত হয়েছিল। ভারতীয় দর্শন, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের বিষয়ে তাঁর অনুরাগ ছিল বিশেষ গভীর। তিনি সত্তরের দশকে পৌরাণিক কাহিনী, ভারতীয় পরমার্থের কাব্য, ধ্যান এবং গল্পকথন বিষয়ে কবিতা, প্রবন্ধ এবং অনুবাদের ১১টি বই প্রকাশ করেন। রবার্ট ব্লাই বিশ্বসাহিত্যের সার্বজনিনতার এক অন্যতম পৃষ্ঠপোষক। তিনি ১৯৭৫ সালে প্রথম বার্ষিক ‘গ্রেট মাদার কনফারেন্স’-এর আয়োজন করেন। ন-দিন ব্যাপি এই ইভেন্টে কাব্য, সংগীত এবং নৃত্যকে মানবিক চেতনা পরীক্ষার জন্য নানাভাবে ব্যবহার করা হয়। এই সম্মেলনটি ২০০৩ সাল থেকে প্রতিবছর মাইনের নোবলবোরোতে অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে। শুরুর দিকে এর প্রধান থিমগুলোর একটা ছিল দেবী বা ‘গ্রেট মাদার’, কারণ, তিনি মানব ইতিহাসজুড়ে বহুচর্চিত। ব্লাই-এর ‘স্লিপার্স জয়েনিং হ্যান্ডস’ বইয়ের অধিকাংশ কবিতাই এই থিমটির সঙ্গে সম্পর্কিত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রসঙ্গে এই ঐশ্বরিক নারীশক্তির প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ করা জরুরি ও প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছিল। সেই সময় থেকে সম্মেলনটি বিভিন্ন প্রকারের কাব্যিক, পৌরাণিক ও রূপকথার ঐতিহ্য বিবেচনা করে প্রসারিত হয়েছে। আট এবং নয়-এর দশকে সম্মেলনের সদস্যমণ্ডলীর মধ্যে সমসাময়িক পরিবর্তন নিয়ে বিশদে আলোচনা হয় এবং পরবর্তীতে সম্মেলনের শিরোনামে ‘দ্য নিউ ফাদার’ যুক্ত করা হয়, যাতে সম্মেলনটি যথাসম্ভব প্রাসঙ্গিকও থাকে।
ব্লাই ছিলেন মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের ২০০২ সালের বিশিষ্ট লেখক। তার আগে ২০০০ সালে পেয়েছিলেন ‘ম্যাকনাইট ফাউন্ডেশনের বিশিষ্ট শিল্পী পুরস্কার’ এবং তারপর ২০০২ সালে লাভ করলেন ‘মরিস ইংলিশ পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ড’। তার প্রকাশিত কবিতাসংকলনের সংখ্যা চল্লিশটির অধিক। এ-ছাড়াও তিনি সম্পাদনা করেছেন প্রচুর এবং সুইডিশ, নরওয়েজিয়ান, জার্মান, এস্প্যানিওল, পার্শিয়ান ও উর্দুতে লেখা অনেক গদ্য ও কবিতার অনুবাদ করেছেন। তার বই ‘দ্য নাইট আব্রাহাম কলড টু দ্য স্টারস’ মনোনীত হয়েছিল ‘মিনেসোটা বুক অ্যাওয়ার্ড’-এর জন্য। ২০০৬ সালে মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় রবার্ট ব্লাই-এর সংরক্ষণাগারটি কিনে নেয় যেখানে ছিল ৮০,০০০-এরও বেশি পৃষ্ঠার হাতে-লেখা পাণ্ডুলিপি, ৫০-বছর ব্যাপি বিস্তৃত একটি জার্নাল, তার ‘মর্ণিং পোয়েমস’-এর নোটবুক, অনুবাদ খসড়া, জেমস রাইট-ডোনাল্ট হল-জেমস ডিকির সঙ্গে তার যোগাযোগের শতাধিক অডিও, ভিডিও এবং চিঠিপত্র। সংরক্ষণাগারটি মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের এলমার. এল. অ্যান্ডারসন গ্রন্থাগারের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে রবার্ট ব্লাই-কে প্রথম ‘পোয়েট লরিয়েট’ নামে অভিহিত করা হয়। আর, ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি আমেরিকার ‘পোয়েট্রি সোসাইটি’ প্রদত্ত আজীবন কৃতিত্বের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘রবার্ট ফ্রস্ট মেডেল’ লাভ করেন।
কবিকে পড়া হত না, জানা-ই হত না সেভাবে, যদি না আমায় এ-ব্যাপারে সোৎসাহে প্ররোচিত করত বিতান। তাহলে অবশ্যই জীবনবোধের এক চূড়ান্ত অনুসন্ধানী ও আত্মসমালোচক এবং ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জীবনকে আত্মকেন্দ্রিকতার বাইরে নিয়ে গিয়ে উপলব্ধিকে মর্মে স্থাপন করা এইসব অনুভূতিমালার আবিষ্কর্তাকে জানতে আমার আরও দেরি হয়ে যেত। বিতানের কাছে তাই এ-বিষয়েও কৃতজ্ঞ থেকে গেলাম আমি। জীবনের বিভিন্ন বয়সের নানান পরতে থাকা টুকরো টুকরো জীবনগুলোকে, বাঁচাগুলোকে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখা ও তার অনুভূতি দিয়ে নিরূপণ করা এই কবি তার কবিতাগুলিতে কথা বলেছেন কখনও পরোক্ষ ন্যারেটিভে, কখনও গল্পের আদলে, কখনও স্পষ্ট ও সরাসরি। কখনও কোনো অলীকের সাথে তার বাক্যবিনিময়, আবেগ-অভিমানের প্রকট ও প্রচ্ছন্ন আদান-প্রদান। কখনও বা একরৈখিক একমুখীনতায় প্রত্যর্পিত তার কথার কোলাজ — যেগুলো আসলে বহুরৈখিক ও বহুমুখী প্রকাশ দ্বারা তার মর্ম উদঘাটন করে চলেছে। একই সময়কালে দাঁড়িয়ে তিনি যে-কোনো দৃশ্যকে দেখছেন আর মিলিয়ে নিচ্ছেন বিভিন্ন বয়সের নিরিখে আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ থেকে। তার কবিতা একই সঙ্গে বড়ো সামাজিক, পারিবারিক, গোষ্ঠীবদ্ধ আবার একান্ত ব্যক্তিগতও। রবার্ট ব্লাই তাঁর কবিতায় উপদেশ বা বাণীর প্রলোভনকে এড়িয়ে গিয়ে সেই নির্জনতার সাধনা করেছেন, সেই সমগ্র ও শূন্যতার সাধনা করেছেন যা ক্রমে এগিয়ে গেছে পূর্ণতার দিকেই। এবং এ-সব তিনি করেছেন জনমানসের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে। তিনি নিজেকে বিচ্ছিন্ন করেননি মানুষের থেকে। সমাজে থেকে, মনুষ্যত্বের দায় থেকে। মানুষের জীবন ও সমস্যা থেকে সরে যাননি, উপরন্তু তাদের একজন হয়েও অনন্য হয়ে উঠেছেন তার গভীর দর্শন ও চিন্তাচেতনার সুললিত প্রয়োগের মাধ্যমে। তিনি তার কাব্যদর্শনের মধ্যে দেখাতে পারেন যে তিমিদের পুকল-বিষাদের নির্মিত ধ্বনিগুলো, বিলাপগুলো থেকেই সৃষ্টি হতে পারে স্বরবর্ণগুলো। একটি সাধারণ ও সামান্য বিবৃতিকেও শিল্পিত করে একটা কবিতা উপস্থাপিত করার অসামান্য কৃতিত্ব এই কবির অন্তদৃষ্টিকে সকলের সামনে চিহ্নিত করিয়ে দেয়। তার কবিতায় মানুষের সাথে মানুষের ভাষায় কথা বলে ওঠে মাঠ, স্বপ্ন, ক্ষেত, সমুদ্র, অন্ধকার। কথা বলে ওঠে বিড়াল, কুকুর, হরিণ, ভাল্লুক ও অন্যান্য জীবজন্তু। কথা বলে ওঠে হাওয়া, ধ্বনি এমনকী নৈঃশব্দ্যগুলোও। সাবলীলভাবে কথা বলে যেতে পারে যে-কোনো কিছু তার সাথে প্রাসঙ্গিকতায়। ব্লাই-এর কবিতায় একজন ব্যক্তির বিভিন্ন বয়স পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আত্মোচ্চারণ করে ওঠে পরস্পর। একেবারে স্বতন্ত্র ও স্বতস্ফুর্ত কাব্যস্বর ও কাব্যভাষার অভূতপূর্ব ব্যবহার প্রতিবার মুগ্ধ করবে পাঠককে, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। শিল্পীর ভেতরে ফিনকি দিয়ে ওঠা আত্মাভিমান এবং তার সংগ্রামী মন ও মানসিকতাকে পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারবে না কিছুতেই।
আমার বন্ধু ও প্রকাশক বিতান চক্রবর্তী আমায় জানিয়েছিল যে এখনও পর্যন্ত বাংলা ভাষায় রবার্ট ব্লাই-এর কবিতার কিছু বিক্ষিপ্ত অনুবাদ হলেও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বড়ো আকারে একটা বইতে অনেক সংখ্যক কবিতার অনুবাদ তার চোখে পড়েনি এযাবৎ। সত্যি বলতে, আমারও জানা নেই বা চোখে পড়েনি তেমন কিছু এখনও অবধি। রবার্ট ব্লাই-এর নাম বহুশ্রুত হলেও বাংলার বেশ কিছু কবিদের মধ্যে অনেকের সাথেই কথা বলেও আমি জেনেছি, যে তার কবিতা এখানে এখনও বহুপঠিত নয়। সেই হিসেবে বলতে গেলে, এটাই হয়তো তার একত্রে অনেক কবিতার অনুবাদের প্রথম সংকলন। আমার মতো একজন অতি সামান্য, সাধারণ, প্রায় অপরিচিত ও আনকোরা শব্দকর্মীর শীর্ণকায় কাঁধের উপর এরকম একটা গুরুভার চাপিয়ে দিয়ে যে বিশ্বাস ও প্রশ্রয়ের দৃষ্টান্ত দিয়েছে বিতান, এত বড়ো সুযোগ করে দিয়েছে আমাকে আমার এযাবৎ চলন ও গমনের পরিসরের বাইরে বেরিয়ে কিছু একটা ‘নতুন’ করে দেখানোর, তার জন্য আমি বিতানের কাছে আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নিচ্ছি।
রবার্ট ব্লাই-এর লেখা এই কবিতাগুলো সরাসরি ইংরেজি ভাষা থেকে বাংলাভাষায় ভাষান্তর করে আমার তরফে বিশ্বসাহিত্যের মনোজ্ঞ পাঠকদের পদপ্রান্তে অর্পণ করা হল। অনুবাদকর্মে এটাই আমার প্রথম কাজ, প্রকৃত অর্থে হাতেখড়ি। বাকি মতামত, পরবর্তী পরামর্শ ও ভুলভ্রান্তিজনিত সমালোচনার জন্য আমি পাঠকের দরবারে তাদের প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রইলাম।