নৌকোয় বই পড়তে পড়তে
সেই নৌকোটির ভেতরে বেশ মস্তিতে ছিলাম আমি, বয়ে যাচ্ছিলাম
ওকপাতার ছাউনির তলায় শুয়ে যেগুলো
ছোট ছোট খণ্ডিত ভাঁজে সাজানো ছিল নিপুণ আলো দিয়ে।
রাত্রি গহীন হয়ে এলে তখন যে ঠিক কত কতবার
খিলখিলিয়ে উঠেছি আমি, কারণ সে আমার
নিকটে এসেছে, থেকে গেছে সাথে, অথবা ফিরে গেছে আবার।
নৌকোটি থামতেই, আমি ঘুম ভেঙে জেগেছি সহসা।
অথচ পৃষ্ঠাগুলো থামছিল না কিছুতেই। আমি ঝাঁপ দিয়ে
বইতে পড়েছি, আর ভেতরে ঢুকে পাকড়াও করেছি শব্দাক্ষরগুলো সব।
সেই মুগ্ধতায় আমার কোনও বেদনা ছিল না, খিদেও ছিল না,
বন্ধু, তখন আমি ছিলাম অভূতপূর্ব বেঁচে, ঘুমিয়ে,
আর পুরোটা সময় ধরে পড়ে চলেছিলাম একটি অমোঘ বই।
এলাবুগার গোলাবাড়িতে
কেমন লাগে “নিহত হয়ে যেতে?” যুদ্ধ করতে করতে নিহত হয়ে যাওয়া
ঘোড়া আর মানুষজনের কাছে সম্মানজনক মৃত্যু হয়ত কোনও।
কিন্তু বিছানায়… মরে যাওয়াতে তেমন দীর্ঘ সংগ্রাম নেই কিছু,
বন্ধ ঘড়ির সামনে ফুঁপিয়ে কর্কশ কান্না নেই, স্বীকারোক্তি নেই।
আর পাদরির তখন দরকার রান্নাঘরে শুধু এককাপ কফি।
এসব সাধারণ মৃত্যু তোমায় স্পর্শহীন ক্ষুদ্র করে দেয় আরও।
কামানের দিকে নিশানা করতে থাকা ছেলেটির একটি ভুলে
ঘোরাগুলো চেঁচিয়ে ওঠে চঞ্চলতায়— যা তোমার বাবার মৃত্যুর কারণ।
বেচারা তখন ঘটনার অপর প্রান্তে খাবার দিচ্ছিলেন পোষা হাঁসদের।
সেই সময়গুলোতে এভাবেই আমাদের পরিবার মুছে গেছে
আমাদের ওপর কোনও চিহ্ন না রেখেই।
কিন্তু আমি প্রশ্ন করতে পারি, কেন আমার বুড়ো-আঙুল ঘুরে বেড়ায়
আমার তর্জনির চারপাশে আমি যখন পড়াশোনা করি, অথবা কেন
সেই শব্দমালা গড়িয়ে নামে মুখ বেয়ে আমার। আমরা জানি যে
মানুষের
প্রবণতা থাকে যুদ্ধের শেষদিকে নিকটবর্তী গোলাবাড়িতে গিয়ে
ঝুলে পড়া, কাউকে কিছু না জানিয়েই।
এক দানবের সাথে বাক্যালাপ
আমি একজন লোককে চিনতাম যিনি নিজের পরিচয় দিতে
পারেননি কখনও।
তোমরাও এমন নমুনা দেখেছ। তার সাথে যখন একটা দানবের
মোলাকাত হল, সে ওই দানবকে উৎসাহিত করেছিল
খাদ্যাভ্যাস নিয়ে আলাপচারিতায় কিন্তু তাকে বোঝাতে পারেনি যে
সে নিজে কারও শিকার হয়ে যেতে সম্মত নয়।
একটা করে দিন কেটে যায়, এক সপ্তাহ, একটা মাস; তখন গ্রীষ্মকাল।
যৌবনোন্মুখ উলভারিনরা তল্লাশিতে বেরোয়;
কাঁকড়াগুলো উঁচিয়ে রাখে হুল; প্রার্থনারত পতঙ্গগুলো হয়ে ওঠে
ক্রমশ ধার্মিক। আর লোকটি শুধু খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যায়।
আপন করে নিতে? আপন হয়ে যেতে? হাস্যকর, কিন্তু ডিম ফুটে
জন্মায় যারা, মনেহয় তাদের গৃহহীনতার কোনও দ্বন্দ্ব থাকে না।
একটা কিছু বহির্মুখে ঠেলতে থাকে তাদের, আর তারা উড়ে যায়
সমুদ্রের দিকে।
সাঁতরে উঠে আসে নুড়ি-কাঁকরের ওপর, দুধস্বচ্ছ হতে হতে ক্রমশ
মিলিয়ে যেতে থাকে।
লোকটি দানবগুলোর কাছে চলে গিয়ে জানতে চেয়েছিল তাকে
নেওয়া হবে কিনা। আমি এসব করেছি প্রায়ই। পাঠক, তোমার কি
জোনাহ্ গল্পের শখ আছে কোনও? একটা দানবকে গিয়ে বলো,
“আমার কাছে তোমার জন্য থাকতে পারে কিছু,
কিন্তু কোনও প্রতিশ্রুতি নেই…”
আমার সঙ্গে বসত করে অন্যজনা
৩।
একটা প্রদীপ আলো ঢেলে দিতে থাকে ঘরের ভেতর, আর সেই ঘরটা
তোমার, এবং সেখানে তুমি লেখো বসে কাব্য-কবিতা। তুমি কখনোই
ট্যারাবেঁকা রেখাগুলোয়, আর ধ্বনির মুক্তির বোধে, এবং
ছাঁচের আশপাশ থেকে উঁকি দেওয়া দৈত্যদের উপস্থিতিতেও
ক্লান্ত হও না।
সেই ছয়-সাতটা শব্দের মেলবন্ধনের যে বিন্যাস, তার
সৌন্দর্যের ছোঁয়ায় যেন গেয়ে উঠতে চায় তোমার সমগ্র চেতনা।
আর আমি মধ্যবয়স্ক এক একাত্ম রাঁধুনির মতোই
নিজের নিজের রান্নার জন্য ঈশ্বরের প্রশংসায় মশগুল হয়ে পড়ি।
অথচ আমাদের প্রশংসা তো মৌমাছির গুঞ্জনের চেয়েও আরও বেশি
ছড়ানো অনেক।
মৌচাকেরও এমন দশা হলে কী যে হত তবে? কে যে তবে শুষে নিত
সবটুকু মধুর মাদক? এটা নিয়ে আর বেশি চিন্তা কোরো না।
শ্রমিকরা বলে, “আমি দূরে উড়ে গিয়ে ধার্মিক হয়ে যাব ঠিক।”
আমার সঙ্গে বসত করে অন্যজনা
১।
যেন অন্য মানুষ কেউ এখানে আমার সাথে আছে, এইখানে এই
ঘরটায়
যেইঘরে আমি শুয়ে আছি। কান যা অনুভব করে শব্দের জন্য
সেই আকাঙ্ক্ষা আমাকে তার সাথে বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়ার মিষ্টতা দিয়েছে।
বিন্দাস একাকী থাকা, শব্দের মধুপানের মজাই আলাদা।
সাদা সাদা দেয়ালের ঘর, এবং স্টিভেন, আর এই সূর্যের আলো—
এটা সেই আত্মোল্লাস যা ডানাকাটা কীটের মতো ছটফটানি সত্বেও
রোদ্দুরের নরম দহন সত্বেও
নিজেকে নিজের কাছে অনাবিল ভরিয়ে রেখেছে।
কল্পিত নারীতে এসে একাকী মানুষ আর থাকে না তো একা।
ইনি সেই নারী যার প্রেমিক থাকে না, এমন রমণী যা-তে
কেবল তখন শুধু ভালোবাসা পায়— যদি কিছু মন থেকে ভালোবাসে
আর সেটা ভালোবেসে যায়…