অক্টোবর ২০২৫ | October 2025

বিভাগ
বুক রিভিউ
৪. এক মহাযাত্রার ধারাভাষ্য: আঞ্চলিক আখ্যান থেকে বৈশ্বিক গাথা
* * * * * *

বই: এখনও সারেঙ্গীটা বাজছে
লেখক: হৈমন্তী শুক্লা
প্রকাশক: মান্দাস
প্রচ্ছদ: সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়
দাম: ৬০০ টাকা
ISBN: 978-93-95065-84-9

সঙ্গীতশিল্পী হৈমন্তী শুক্লাকে যখন আপামর বাঙালি আকাশবাণীর অনুরোধের আসরে প্রথম শুনলো, শ্রোতারা তাঁর গানের মাধুর্যে যেমন আবিষ্ট হয়েছিলো, ঠিক তেমনই তাঁর অদ্ভুত সুন্দর পদবীও মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল। সঙ্গীতাচার্য হরিহর শুক্লার মেয়ে হৈমন্তীর গানজীবন শুরু হয়েছিল হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম রেকর্ড। গানজীবনের ষাট বছর পেরিয়ে এসে, অজস্র গানের মনি-মানিক্যে ঠাসা সেই গানের ভুবন। তাঁর গানের জগত শুধু গানের প্রকৃতির দিক দিয়েই বৈচিত্রে ভরপুর এমন নয়, এই সুদীর্ঘ্য গানজীবনে অজস্র গুণী ও প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতজ্ঞের সান্নিধ্য ও তাঁদের থেকে পেয়েছিলেন শিক্ষা। হৈমন্তী শুক্লার নিজের স্মৃতি রোমন্থনের এই মধুরতাই ছড়িয়ে আছে ‘এখনও সারেঙ্গীটা বাজছে’ বইটিতে।
শিশুবয়সে, যখন মেয়েরা পুতুল খেলায় খুশি থাকে, তখন থেকেই হৈমন্তী শুক্লার গানকে ভালোবাসা শুরু। বাবার কাছেই তাঁর প্রথম রেওয়াজের হাতেখড়ি। একেবারে শিশু বয়সের গান শেখা বা বিভিন্ন সংগীত প্রতিযোগীতায় যোগ দেওয়া ও প্রথম হওয়ার স্মৃতি রোমন্থনের মধ্যে তিনি ফিরে দেখেছেন সেই সময়ে গোলাম আলী খাঁ সাহেব, চিন্ময় লাহিড়ী এঁদের মতন সঙ্গীতজ্ঞের স্নেহে বড় হয়ে ওঠাকে।
হৈমন্তী শুক্লার স্মৃতিকথা শুধু যে তাঁর যাপনকে তুলে ধরেছেন তা নয়, এই স্মৃতিকথা সেইসময় এবং সমাজেরও প্রতিফলন আমাদের কাছে তুলে ধরে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার শেষ যখন গানেই মনোনিবেশ করতে চাইছিলেন, পারিবারিক কারণে তা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। ফলে আশ্রয় নিয়েছিলেন প্রিয়বন্ধুর দিদির বাড়িতে। খুব অল্প কথাতেই সে সময়ের সামাজিক চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন। বাবা হরিহর শুক্লা সঙ্গীতাচার্য হওয়া সত্ত্বেও বাড়ির মেয়ের গান গাওয়া ততখানি সমাদৃত ছিল না। খেয়াল, ঠুংরি ইত্যাদি বাংলার রাগ-প্রধান গানে তাঁর পারদর্শিতা থাকা সত্ত্বেও বাংলা আধুনিক গানের প্রতি তাঁর ছিল প্রবল আকর্ষণ। সেই কারণেই ১৯৭২ সালে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় এবং শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে তাঁর প্রথম আধুনিক গান হিন্দুস্তান রেকর্ডস রেকর্ড হয়— “এ তো কান্না নয় আমার”। আকাশবাণী অনুরোধের আসরে বারে বারে সেই গান বাজানো হতে থাকে শ্রোতাদের অনুরোধে। ফলে বাংলা আধুনিক গানের জগতে হৈমন্তী শুক্লা পরিচিত কণ্ঠ হয়ে উঠলেন।
ধারাবাহিকভাবে, সাল-তারিখ অনুযায়ী স্মৃতিকথা এখানে লেখেননি। ছোট ছোট অনুচ্ছেদে তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য সময়গুলোকে ধরে রেখেছেন। দীর্ঘ সঙ্গীতজীবনে বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ মানুষের সাথে তাঁর আলাপ হয়েছে, তাঁদের সাথে বিভিন্ন কালজয়ী গান তৈরি হয়ে ওঠার গল্পকে ছোট ছোট ঘটনায় বর্ণনা করেছেন।
‘আমি যখন সলিল সাগরে’, ‘মান্নাদা জুড়েছিলেন দাদার মতো করেই’ বা ‘আমার জন্য বড় কঠিন কঠিন সুর করতেন মানব দা’, এই সমস্ত অনুচ্ছেদের নাম পড়লেই পাঠক ধারণা করতে পারবেন শিল্পী কোন সময়ের কথা এখানে বলতে চেয়েছেন। এমনকি যে সমস্ত পাঠকদের অনুরোধের আসর শোনার অভ্যাস ছিল তারা অবশ্যই নস্টালজিক হবেন, কারণ বিভিন্ন জনপ্রিয় গানকে তারা এই অনুচ্ছেদের নাম পড়ার সাথে সাথেই মনে করতে পারবেন যেমন— ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না’, ‘ছন্দে ছন্দে হিয়া দোলে আনন্দে’, ‘এমন স্বপ্ন কখনো দেখিনি আমি,’ ইত্যাদি।
এ বই কেবল হৈমন্তী শুক্লার তাঁর সঙ্গীতজীবনের স্মৃতিকথা নয়, তাঁর একাকী জীবনের কিছু অমূল্য স্মৃতিও তুলে রেখেছেন পাতায়। এমনকি দীর্ঘজীবনে কোথাও হৃদয়ের ঘনিষ্ঠতার কথাকেও ফিরে দেখতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সাথে তাঁর কাজের কথা, তাঁর সাথে আলাপ হওয়ার কথা, রবি শংকরের সুরে গান গাওয়ার অমূল্য স্মৃতিচারণ তিনি যেমন করেছেন ঠিক তেমনি রবি শংকর যে তাকে একটি ব্যক্তিগত অনুরোধ করেছিলেন সেটিও শিল্পী অকপটে এখানে জানিয়েছেন এবং তার উত্তরে যে তিনি বলেছিলেন তিনি সারাজীবন পণ্ডিত হরিহর শুক্লার মেয়ে হৈমন্তী শুক্লা হয়েই থাকতে চান, অন্য কোন পরিচয় কে তিনি গানের থেকে বেশি সম্মান দিতে পারবেন না।
একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণার ক্ষেত্রে একটি অনুচ্ছেদে তিনি নামকরণ করেছিলেন ‘কোন রটনায় কান দেয়নি হেমন্ত-হৈমন্তী জুটি’ শিরোনাম থেকেই ধারণা করা যায় যে কিছু বাজার-চলতি গুজবের কথা এখানে উল্লেখিত থাকতে পারে। কিন্তু শিল্পী শুধুমাত্র এটুকুই বলেছেন তাদের শৈল্পিক বোঝা পড়া দীর্ঘকালের। কিছু সময়ের জন্য তাঁদের যোগাযোগ ছিল না পরবর্তীতে তা আবার একই রকম অমলিন হয়ে উঠেছিল। সংক্ষিপ্ত এবং মার্জিত বিবরণে বুঝিয়ে দেন, সত্যিই তো তাঁদের জীবনে সঙ্গীতের মায়াময়তায় এসব ঘটনা তো বড়ই অকিঞ্চিতকর। এটি একটি বহুল প্রচলিত গুজব হওয়া সত্ত্বেও এড়িয়ে যাননি তিনি।
অনুজ-প্রতিম, বিভিন্ন সংগীত ব্যক্তিত্বরা, ওস্তাদ রশিদ খান, পিন্টু ভট্টাচার্য, ওস্তাদ জাকির হোসেন, এঁদের প্রত্যেকের তিনি ছিলেন স্নেহশীলা দিদির মতন। সেই সব গল্প ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর স্মৃতি কথায়। এবং আরও বিভিন্ন সঙ্গীতজ্ঞ, ভীমসেন যোশী, নওশাদজি, আলী আকবর খাঁ, এদের প্রত্যেকের সাথে তার সঙ্গীতজীবনের বিভিন্ন আদান-প্রদান, কখনো গান তৈরি হয়ে ওঠা বা কখনো শুধুই তাদের উপস্থিতিতে গানের সম্বন্ধে জ্ঞান লাভ করা, এইরকম টুকরো টুকরো স্মৃতির কোলাজ ছড়িয়ে রয়েছে এই বইতে। একজন মাত্র শিল্পীর জীবনে এত দিকপাল মানুষের উপস্থিতির কথা পাঠককে রোমাঞ্চিত করে তুলবে।
হৈমন্তী শুক্লার স্মৃতি কথা যেমন তাঁর জীবনের প্রাপ্তির কথা জানায়, তেমনি তাঁর কিছু-কিছু না পাওয়া কথাও রয়েছে। তাঁর ইচ্ছা ছিল, সুচিত্রা সেনের জন্য বাংলা ফিল্মে গান গাওয়ার। কিন্তু যখন বাংলা ফিল্মের জন্য সংগীত শিল্পী হিসেবে তাঁর পরিচিতি হচ্ছে তখন সুচিত্রা সেন ধীরে ধীরে সিনেমা থেকে সরে যাচ্ছেন। ঋত্বিক ঘটকের সাথে তাঁর আলাপ হয়েছিল দিল্লিতে। ঋত্বিক ঘটক তাঁর ভাটিয়ালী গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন, চেয়েছিলেন তাঁর সিনেমায় যেন হৈমন্তী শুক্লা গান করেন। কিন্তু সেটা হওয়াও সম্ভবপর হয়নি অসময়ে ঋত্বিকের চলে যাওয়ার কারণে। এমনই কিছু ছোট ছোট আক্ষেপ এই স্মৃতি কথায় ছড়িয়ে আছে।
তাঁর গায়কী জীবনের বিভিন্ন গানের তৈরি হওয়ার গল্প যেমন রয়েছে এই বইতে তেমনই তিনি বলেছেন সুমন এবং নচিকেতার সম্পূর্ণ নতুন ধরনের গানের সঙ্গে তাঁর একাত্ম্য হওয়া, সুমন এবং নচিকেতার সুরে গান গাওয়ার গল্পও তাঁর কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।
এই বইয়ের বিশেষ উল্লেখযোগ্য অংশ হলো, এখানে কিছু অমূল্য ফটোগ্রাফ রয়েছে এবং রয়েছে কিছু বিখ্যাত ব্যক্তি যেমন রবি শংকর, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, পরিচালক তপন সিংহের লেখা চিঠির প্রতিলিপি। বইয়ের প্রচ্ছদ এবং বাঁধাই যথেষ্ট প্রশংসনীয়, খুব সামান্য দু-একটি উর্ধ্ব কমার ভুল স্থাপনা ছাড়া ছাপার ভুল নেই বললেই চলে। তবে একদম প্রথম দিকে হৈমন্তী শুক্লার শিশু বয়সের দুটি ফটো দেওয়া হয়েছে। সেই ফটো দুটির ক্যাপশনটা অদল বদল হয়ে গিয়েছে। ওপরের ছবির ক্যাপশনটা নিচে যাওয়া উচিত ছিল এবং নিচেরটির উপরে। আশা করা যায় প্রকাশক পরবর্তী সংস্করণে এই সামান্য ত্রুটি গুলি সংশোধন করে ফেলবেন।