Menu Close

শিশুপাঠ্য, শিশু অস্ত্র

বিতান চক্রবর্তী

অক্টোবর ২০২৫ | October 2025

বিভাগ

বুক রিভিউ

১. স্মৃতিতে সারেঙ্গীর সুর

২. শিশুপাঠ্য, শিশু অস্ত্র

৩. আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া দিন

৪. এক মহাযাত্রার ধারাভাষ্য: আঞ্চলিক আখ্যান থেকে বৈশ্বিক গাথা

বই: সুকুমার রায় ছড়া সমগ্র
লেখক: সুকুমার রায়
প্রকাশক: হাওয়াকল-শূন্য
প্রচ্ছদ: লিমা নায়েক
ISBN: 978-81-988424-1-1

সে এক সময়, যখন কবিতার পোকা ধীরে ধীরে আমার মাথা খাচ্ছে। গোপন ডায়েরিতে শব্দ ভেঙে কবিতার জন্ম দেখছি প্রায় প্রতিদিন।

তখন স্কুল পেরিয়ে কলেজ, মফসসল পেরিয়ে শহর। সে সময়ই আলাপ হল প্রবীরদার সঙ্গে। “জ্যোতিরিঙ্গণ” পত্রিকার সম্পাদক। প্রবীরদা এক সকালে প্রস্তাব দিলেন, “পত্রিকার নতুন সংখ্যায় তুই একটা প্রবন্ধ লেখ সুকুমার রায়কে নিয়ে। জানিস তো এ-বছরটা আবোল তাবোল-এর আশি বছর”। আমি জানতাম না। সেদিনই প্রবীরদা আমাকে নিয়ে গেলেন গরপাড়ে, যেখানে সুকুমার রায় তাঁর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। বর্তমানে যা এথেনিয়াম স্কুল। স্কুল গেটের বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা অনেকটা সন্ধ্যা। স্কুলের উলটো দিকের রোয়াকে বসে দেখছি। মূল বাড়িটির হয়তো পরিবর্তন হায়ে গেছে অনেক কাল আগেই। কিন্তু, এই বাড়ির বাতাসে বাংলা ছাপাখানা থেকে বাংলা ননসেন্স পোয়েট্রির বিপ্লবী গন্ধ ভেসে আসে। এই সেই বাড়ি যার সিঁড়ি বেয়ে নেমে সুকুমার গিয়েছিলেন লন্ডন, প্রিন্টিং টেকনোলজি পড়তে। তাও আবার রবি ঠাকুরের উৎসাহে। বাংলার প্রিন্টিংকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়ার সেই উৎসাহ আজ যেন কোন কানাগলিতে হারিয়েছে। লন্ডনের সভায়

সুকুমার রায় পাঠ করলেন রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে প্রবন্ধ, The Spirit of Rabindranath Tagore (১৯১৩)। বলা যেতে পারে এই প্রবন্ধটিই প্রথম রবিবাবুকে বিশ্বসংসারের সঙ্গে পরিচিত করালো।

এই সমাজব্যবস্থা, রাজনীতির ওপর আমার রাগ হলে আমি লেখাতে চিৎকার করি। সুকুমার সে রাগকে প্রবাহিত করে দেন আমাদের মস্তিষ্কের গভীর প্রকোষ্ঠে। ভেঙে পড়া রাষ্ট্রের মঞ্চেই বাচ্চারা হেসে হেসে বলতে থাকে,

ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি মারব না—
সত্যি বলছি কুস্তি ক’রে তোমার সঙ্গে পার্‌ব না।
মন্‌টা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগ্‌টি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই!
মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না—
জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতই না?

এস এস গর্তে এস, বাস ক’রে যাও চারটি দিন,
আদর ক’রে শিকেয় তুলে রাখ তোমায় রাত্রি দিন।
হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাক্‌বে না?
মুগুর আমার হাল্কা এমন মারলে তোমায় লাগ্‌বে না।
অভয় দিচ্ছি, শুন্‌ছ না যে? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা?
বস্‌লে তোমার মুণ্ডু চেপে বুঝবে তখন কাণ্ডটা।

আমি আছি, গিন্নী আছেন, আছেন আমার নয় ছেলে—
সবাই মিলে কাম্‌ড়ে দেব মিথ্যে অমন ভয় পেলে।

শুনে প্রকাশ্যে রাষ্ট্র হাসে বাচ্চাটির মতন। কিন্তু গভীর রাতে রাষ্ট্রযন্ত্রটির মাথার ভেতর সিড়সিড়ানি হয় না? পাণ্ডিত্যের ওপর এমন আঘাত সম্ভবত বিদ্যাসাগর মহাশয়ও দিয়ে যেতে পারেননি।

…খানিক বাদে ঝড় উঠেছে ঢেউ উঠেছে ফুলে,
বাবু দেখেন নৌকোখানি ডুব্ল বুঝি দুলে।
মাঝিরে কেন, “একি আপদ! ওরে ও ভাই মাঝি,
ভুল নাকি নৌকো এবার? মরব নাকি আজি?”
মাঝি শুধায়, “সাঁতার জানো?” মাথা নাড়েন বাবু,
মূর্খ মাঝি বলে, “মশাই এখন কেন কাবু?
বাঁচলে শেষে আমার কথা হিসেব করো পিছে,
তোমার দেখি জীবনখানা ষোল আনাই মিছে।”

হিউমারের ক্ষমতা, সুকুমারের আগে বাংলা সাহিত্যে কেউ দেখিয়েছেন বলে আমার জানা নেই।

গোর্কে বলতেন বিপ্লবের পতাকা শিশুদের হাতে তুলে দাও, বাকিটা পথ তারাই হাঁটবে। আর সুকুমার রায় শিশুপাঠ্যের মধ্যেই বপন করে দিয়ে গেলেন সেই বীজটি, যার ফসল ‘মজা’ হলেও, অসাম্যের সমাজ ব্যবস্থাকে চোখ রাঙাতে ভয় পাবে না। হাওয়াকল-শূন্য সংস্করণে সুকুমার রায় কবিতা সমগ্র আগামীর সেই সব নির্ভীক শিশুদের জন্যই উৎসর্গীকৃত হল।

Spread the love

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *