Menu Close

এক মহাযাত্রার ধারাভাষ্য: আঞ্চলিক আখ্যান থেকে বৈশ্বিক গাথা

শ্রীজিৎ সরকার

অক্টোবর ২০২৫ | October 2025

বিভাগ

বুক রিভিউ

১. স্মৃতিতে সারেঙ্গীর সুর

২. শিশুপাঠ্য, শিশু অস্ত্র

৩. আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া দিন

৪. এক মহাযাত্রার ধারাভাষ্য: আঞ্চলিক আখ্যান থেকে বৈশ্বিক গাথা

বই: তিনটি উপন্যাস
লেখক: সৈকত রক্ষিত
প্রকাশক: তবুও প্রয়াস
প্রচ্ছদ: সুপ্রসন্ন কুণ্ডু
দাম: ৪৫০ টাকা
ISBN: 978-93-87743-91-5

মূলধারার সাহিত্যের (Mainstream Literature) একটি বিশেষ (এবং গুরুত্বপূর্ণ) উপধারা আঞ্চলিক সাহিত্য (Regional Literature), বাংলায় যার চর্চার ইতিহাসটি যথেষ্ট সুপ্রসিদ্ধ এবং সুসমৃদ্ধ। যদিও কোনও একজন প্রান্তিক চরিত্রকে কেন্দ্র করে রচিত কাহিনির সঙ্গে প্রকৃত আঞ্চলিক সাহিত্যের পার্থক্য যথেষ্ট।

একটি আদর্শ আঞ্চলিক উপন্যাসের কী কী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গসাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ গ্রন্থে একটি সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছেন:

 ১. কাহিনিকে অপরিচয়ের রহস্যমণ্ডিত হতে হবে, অর্থাৎ বর্ণিত ঘটনাবলীতে সুপরিচিত জীবনের প্রত্যক্ষ প্রভাব থাকলে চলবে না।

 ২. কাহিনির পটভূমি সুদূর ভৌগোলিক ব্যবধানে অবস্থিত কোনও বিশেষ অঞ্চল হতে হবে।

 ৩. উপন্যাসে কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনসাধারণ, সামাজিক রীতি-নীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কারের চিত্র স্পষ্টভাবে অঙ্কিত হতে হবে।

 ৪. এক বিশেষ ধরণের বৃত্তিজীবীগোষ্ঠীর এক বিশেষ জীবনবোধের চিত্র কাহিনিতে প্রতিফলিত হতে হবে।

আলোচ্য গ্রন্থে সংকলিত তিনটি উপন্যাস—আখচাষিদের জীবন ও গুড়ের বাণিজ্য নিয়ে লিখিত ‘সিরকাবাদ’, রুক্ষ্ম অঞ্চলের জলসংকট ও সরকারি জলদুর্নীতি নিয়ে রচিত ‘ঢেঁকিকল’ এবং সিমেন্ট কারখানা নির্মাণের উদ্দেশ্যে গ্রামবাসীদের উৎখাত ও বলপূর্বক জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে লিখিত ‘আকরিক’ যে উক্ত মানদণ্ডের প্রাথমিক বিচারে উত্তীর্ণ—তা বলা চলে সন্দেহাতীতভাবে।

কিন্তু যে কোনও সাহিত্যকর্মের যথার্থতা সংজ্ঞায়িত হওয়ার জন্য তত্ত্বগত উদ্দেশ্যসাধনের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় বৃহত্তর ক্ষেত্রে তার প্রাসঙ্গিকতা এবং সময়কাল ও ভৌগোলিক সীমারেখাকে অগ্রাহ্য করে গুরুত্বপূর্ণের শিলমোহরটি অটুট রাখার মতো উপযোগিতা। সেক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপিত হতেই পারে: তবে কি এই লেখাগুলির উদ্দেশ্য শুধুই কিছু বিশেষ জনজাতির জীবনযাপন সম্পর্কে গল্পচ্ছলে বাকি পৃথিবীকে অবহিত করা, যার পোশাকি নাম দেওয়া হয়েছে ‘ইনফো-ফিকশন’?

উত্তরটি হল: না। গল্পচ্ছলে তথ্য বা তথ্যচ্ছলে গল্পের সরলীকৃত সংজ্ঞা পেরিয়ে এই তিনটি লেখার সীমানা বিস্তৃত হয়েছে বহূদূর।

একাধারে নাগরিক এবং প্রান্তিক জীবনের অনিবার্য সংঘাত যেমন উপন্যাসগুলির বিষয়বস্তু হিসাবে উঠে এসেছে, অধিকার আদায়ের দাবীতে বিবিধ উপজাতির সংঘবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধে সামিল হওয়ার উল্লেখ যেমন রয়েছে—তেমনই গুরুত্ব পেয়েছে আঞ্চলিক শ্রেণীগুলির নিজস্ব গোষ্ঠীকোন্দল, অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের ত্রিবিধ আবর্তে সুখী থাকা মানুষদের অজান্তেই বৃহত্তর কৌশলের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়া ও অনাকাঙ্ক্ষিত চূড়ান্ত পরিণতির দিকে অগ্রসর হওয়া। এছাড়া উল্লেখ করতেই হয় স্বজনের মৃত্যুতে আপাত-নিরীহ মানুষের মধ্যে প্রতিহিংসার স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ, উত্তরপুরুষের ভবিষ্যৎ সুনিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হিসাবে দ্রোহের পথ অবলম্বন করা, ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবীতে নিতান্ত নির্বিরোধী এবং সংসারী মানুষেরও অস্ত্র হাতে বিক্ষোভে সামিল হওয়ার মতো খণ্ডদৃশ্যগুলির কথা—যেগুলি মানবমনের পরিস্থিতিগত রূপান্তরের সার্থক চিত্রলেখ হয়ে উঠেছে। তারা শুধু কোণঠাসা জনগণের হিংস্র রিপুর বহিঃপ্রকাশকেই চিত্রিত করেনি, বরং হয়ে উঠেছে লেখকের নির্মোহ ও বহুস্তরীয় জীবনবোধের প্রামাণ্য দলিল।

অন্যান্য সামাজিক কাহিনির সঙ্গে আঞ্চলিক উপন্যাসের প্রধান পার্থক্যটি সহজেই প্রনিধানযোগ্য: সাধারণ সামাজিক কাহিনি রচনার জন্য পর্যবেক্ষণক্ষমতার পাশাপাশি প্রয়োজন সূক্ষ্ম জীবনবোধ এবং তীক্ষ্ণ কল্পনাশক্তি; কিন্তু আঞ্চলিক কাহিনির ক্ষেত্রে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা—যা একটি জনজাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের রূপান্তর, দৈনিক জীবনচর্যার পরিবর্তন, পরিবর্তনশীল আর্থ-সামাজিক সংকটের মূল হেতু এবং সংঘাতের প্রতিরূপকে গভীরভাবে অনুভব করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়ে ওঠে। পুরুলিয়া এবং সন্নিহিত অঞ্চলে লেখক দীর্ঘদিন বাস করেছেন, নিবিড়ভাবে মেলামেশা করেছেন সেখানকার বাসিন্দাদের সঙ্গে, আত্মস্থ করেছেন তাদের জীবনচর্যা। লেখকের এই ব্যক্তিগত যাপনই যে তাঁর সাহিত্যকর্মের ঋদ্ধি এবং সমৃদ্ধির অন্যতম কারণ, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।

লেখকের নির্মেদ গদ্য, সংলাপে আঞ্চলিক ভাষার যথেচ্ছ প্রয়োগ, প্রচলিত বাগধারার ব্যবহার এবং বয়ান-নির্মাণের জন্য ব্যবহৃত নির্লিপ্ত দৃষ্টিভঙ্গী মনে করিয়ে দেয় মহাশ্বেতা দেবীর কথা। যদিও কেন্দ্রীয় সংকট নির্বাচন, অপূর্ণ বাক্যের প্রভূত সমাহার, যৌনতার প্রায়-অদৃশ্য উপস্থিতি, যতিক্ষেপণের প্রচলিত নিয়মকে অগ্রাহ্য করে নিজস্ব প্রয়োগনীতিকেই মান্যতা প্রদান, গুরুত্বপূর্ণ নারীচরিত্রের উল্লেখযোগ্য অনুপস্থিতি ইত্যাদি কারণে সৈকত রক্ষিত স্বাতন্ত্র অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়া মহাশ্বেতা দেবী লেখার প্রেক্ষাপট হিসাবে নির্বাচন করেছেন এসেছে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলকে; কিন্তু সৈকত রক্ষিত ঘোরাফেরা করেছেন মূলত পশ্চিমবঙ্গের একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যেই।

লেখক যে উপন্যাসের নির্মাণ ও গঠনগত শৈল্পিকতার (Constructional and Structural Artistry) থেকেও স্বতঃস্ফূর্ত অগ্রগতি ও প্রবাহমানতাকে (Spontaneous Precession and Sequencing) অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন, ভাষার কারুকার্য ও উপমার ব্যবহারকে অপ্রয়োজনীয় শ্রেণীভুক্ত করে বেছে নিয়েছেন অনাড়ম্বর সরল কথনের (Linear Narrating) পথ—তা স্পষ্ট বোঝা যায় লেখার সামগ্রিক কাঠামোগুলিকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই। বিশেষত লেখার অসম গতি এবং ভাষ্যের রদবদল, মূল ঘটনাপ্রবাহের থেকেও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক বিষয়কে অধিক গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি উপরোক্ত বিষয়গুলিকেই নির্দেশিত করে। এক্ষেত্রে ‘আকরিক’ উপন্যাসটির কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—যেখানে সেই অর্থে কোনও কেন্দ্রীয় চরিত্র নেই এবং কাহিনির আরম্ভ প্রমিত বাংলায় হলেও, তৃতীয় পরিচ্ছদ থেকেই গদ্যটিও নির্মিত হয়েছে আঞ্চলিক ভাষার সমাহারে।

তবে উপন্যাসগুলিতে উত্তোরণের মুহুর্তও এমনকিছু অপ্রতুল নয়। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে ‘সিরকাবাদ’ উপন্যাসের একটি অংশ: “আবহমানকাল ধরে তারা নিংড়ে দিচ্ছে তাদের শরীর। পানা সেই রক্তেরই নাম। সিরকা সেই রক্তেরই গাঁজলা। গুড় সেই রক্তেরই জ্বাল খাওয়া পরিস্রুত নির্যাস!”—যেখানে উৎপাদকের স্বেদ-শোণিত আর পণ্যের সারবত্তাকে লেখক মিলিয়ে দিয়েছেন অক্লেশে। আবার, আপাতভাবে যাকে ধর্মীয় মতাদর্শগত সংঘাত বলে মনে হয়, তার শিকড় যে প্রোথিত থাকে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডের প্রকাণ্ড পটভূমিতে—‘ঢেঁকিকল’ উপন্যাসের “আর যে-গ্রামে হিন্দু-মুসলমানের সহবাস, সেখানে এই জল-কলহ থেকেই হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-সন্ত্রাসের সূত্রপাত।” অংশে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে সেই চিরন্তন সত্য।

তবে বইটিতে কিছু শব্দটিকা থাকলেও, ক্ষেত্রবিশেষে তাতে যথেষ্টতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। এছাড়া, একটিই ঘটনা বর্ণনার জন্য ব্যবহৃত ক্রিয়ায় কালের বিভিন্নতাও (উদাহরণ হিসাবে বলা চলে—একটি বাক্য গঠিত হয়েছে সাধারণ বর্তমানে, ঠিক পরবর্তী বাক্যটিতেই ব্যবহৃত হয়েছে সাধারণ অতীত) কখনও কখনও পাঠসুখের ব্যাঘাত ঘটায়। এক্ষেত্রে একজন দক্ষ সম্পাদকের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা যায় না।

শেষ কথা হিসাবে বলা যায়: তাহলে আলোচ্য বইটির মূল গুরুত্ব কোনটি?

এই বিচারের দায় বর্তাক পাঠকের উপর। তবে একথা অনস্বীকার্যে যে, যুগসংঘাতের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে থাকা তথাকথিত অন্ত্যজ মানুষদের এই অভাব-অপ্রাপ্তি-অসাম্যের আখ্যান শেষাবধি শুধু একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সংকট থাকে না; বরং, প্রায়-নিরালঙ্কার গদ্য যেন বৃহত্তর পরিপ্রেক্ষিতের সাপেক্ষে হয়ে ওঠে নিষ্করুণ প্রান্তিক জীবনের স্বার্থক ভাষ্য। বীরবল, সহদেব, পরিমল, নিত্যানন্দ, কিঙ্কর দত্ত, বুধা পালদের জাতিগত পরিচয় এবং ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বহীন হয়ে আসে ক্রমশ; শুধু তাদের দাবীগুলি—শিক্ষিত বনাম অশিক্ষিত, গ্রাম্য বনাম শহুরে, সূক্ষ্ম বনাম স্থূল ইত্যাদি বিভেদ পেরিয়ে যাদের আবেদন সার্বজনীন বঞ্চিত শ্রেণীর জন্য গুরুত্বপূর্ণ—তা হয়ে ওঠে অসাম্যের বৈশ্বিক ইতিহাসের অন্তর্লীন স্বর।

Spread the love

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *