Menu Close

আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া দিন

বিতান দে

অক্টোবর ২০২৫ | October 2025

বিভাগ

বুক রিভিউ

১. স্মৃতিতে সারেঙ্গীর সুর

২. শিশুপাঠ্য, শিশু অস্ত্র

৩. আমাদের ফুরিয়ে যাওয়া দিন

৪. এক মহাযাত্রার ধারাভাষ্য: আঞ্চলিক আখ্যান থেকে বৈশ্বিক গাথা

বই: নিঃস্ব মফঃস্বলের দিনলিপিরা
লেখক: রজত দাস
প্রকাশক: কালি কলম ও ইজেল
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ: হিরণ মিত্র
দাম: ১৭০ টাকা
ISBN: 978-81-974328-9-7

এমন যদি হত, মন চাইতেই বেরিয়ে পড়া যেত যেদিক দু-চোখ যায়, তবে? ইচ্ছে থাকে কিন্তু উপায় হয় না সহজে। মন চলে নিজ নিকেতনে, শরীর বলে থাক বরং বিশ্রাম নেওয়া যাক খানিক। এমতবস্থায় উপায় ভাবতে ভাবতে দ্বারস্থ হওয়া কিছু বইয়ের কাছে। সহজেই মনের ছুটি আর বাধাহীন ঘোরাঘুরি ভাবনার রাজ্যে। শরীরের ক্লান্তির ভিতর চলে আসে এক টুকরো মফঃস্বল, আর তার দিনলিপিরা হয়ে ওঠে সঙ্গী। লেখক বলবেন, ‘নিঃস্ব মফঃস্বলের দিনলিপিরা’ আর পাঠক ভাববেন মফঃস্বল কীভাবে নিঃস্ব হতে পারে? এইসব ভাবনার উত্তর খুঁজতে খুঁজতে আমরা অনেকেই আমাদের ছোটোবেলার ফেলে আসা দিনে ফিরে যেতে পারি অনায়াসেই। সে কেমন ছোটোবেলা? 

শহর তার পরিচিত ঢঙে ভুলিয়ে দিতে পারে বহু অস্তিত্বকে। শহুরে ধারায় এমন অনেক মফঃস্বল হারিয়ে যায়, হারাতেই থাকে। যারা মফঃস্বলকে আঁকড়ে ধরে কাটিয়েছে তাদের শৈশব-কৈশোর, তারা এই হারানো স্মৃতির অবিচ্যুয়ারি তৈরি করেন বা করেন না। চা দোকান, আড্ডা, ঠাকুর তৈরি, নদীর পাড়—এমন কতশত বিষয় আর ফিকে হয়ে আসা স্মৃতি। নিজেদের মফঃস্বলি যাপনে চলে আসা এমন বহু কথার সহজ ছবি মন ভার করে। হঠাৎ কোথাও বেরিয়ে পড়া, আর তার ভিতরেও মিশে থাকা নিজের মফঃস্বল। রজত দাস তাঁর ‘নিঃস্ব মফঃস্বলের দিনলিপিরা’ গ্রন্থে এমন অনেক হারিয়ে যাওয়া অভ্যাসকে খুঁজে দেখতে চান, ফিরে যেতে চান কিছু মায়াবী অতীতে।

বইয়ের একটি ছোট্ট উৎসর্গ, ভীষণ মন কেমন করা, “কাঁচড়াপাড়া আমাদের/ ফুটবল খেলার ছোট্ট মাঠ/ যে আজ আক্ষরিক অর্থেই প্যান্টালুনসের দোকানের জন্য/ বাতাসে বিলীন হয়ে গেছে …” এমন বহু কাঁচড়াপাড়া এবং ফুটবল খেলার মাঠ বিলীন হয়ে গেছে, বিলীন হয়ে যাওয়াই তাদের ভবিতব্য। কেবল মফঃস্বল নয়, শহরের বুক থেকে হারিয়ে গেছে বহু মাঠ, জলাভূমি। আকাশছোঁয়া কংক্রিট আর আলোর রোশনাইয়ে সেইসব মাঠের প্রেত ঘুরে মরে। ক্রমশ আধুনিক হয়ে উঠতে চাওয়া মফঃস্বল তাই হারিয়ে ফেলেছে অনেককিছুই। উৎসর্গ পেরিয়ে বইয়ের সূচি আরও বিস্ময় তৈরি করে। সংক্ষিপ্ত কিছু শিরোনাম, আপাত সরল অথচ তার ভিতর বয়ে চলা কিছু সূক্ষ্ম অনুভূতি, দর্শন, কথকতা! শিরোনামে আসে কুশিয়ারা, জুতো, বিশ্বকর্মা, খেলনানগর, লাস্ট ট্রেন, সেতু, ছলাৎ, ইজিচেয়ার, জন্মদিন-এর মতো কিছু নাম। এক একটি শিরোনাম যেন আমাদের অনেকের কথা হয়ে ওঠে। একটি লেখার ভিতর থাকে আরও বহু লেখা।

যেমন ধরুন কুশিয়ারা লেখাটির ভিতর চলে গেলে এই নদীর কথা পাবেন আপনি। আসামের কুশিয়ারা নদী, ডিসেম্বরের শীত ও ঘন কুয়াশা। নদীর পাড়ে আলাপি নতুন মানুষদের সঙ্গে গল্প। জল স্পর্শ করে ভাসিয়ে দেওয়া কাগজের নৌকো, মনে পড়ে যাওয়া ভিটে, সেই নৌকো যেন চলে যায় ফেলে আসা ভিটের উদ্দেশে। কুশিয়ারা নদীর ওপারে বাংলাদেশ, নদীর জলে পা দেওয়ার অধিকার নেই কারও। দেশভাগের ভয়াবহ কিছু স্মৃতি আমাদের অনেকের মনে উঁকি দিয়ে যায় চকিতে, ফেলে আশা কতকিছু মেনে নিতে হয়েছে। কেবল পাখিদের কোনো সীমান্ত নেই। অনায়াসে তাই কাক উড়তে উড়তে চলে যায় সীমান্তের ওপারে। নিজেদের দেশ, নিজেদের নদী, সত্যিই কি নিজেদের? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে খুঁজতে বাকি আরও কিছু লেখার ভিতর চলে যেতে মন চায়।

বেশ কিছু লেখার শব্দ পেরোতে পেরোতে চোখ গিয়ে থামে এক শিরোনামে, জুতো। পুজো আসছে। পুজোর রকমারি তালিকার ভিতর থাকে জুতো। আমাদের অনেকের ছোটোবেলা জুড়ে জুতোর রঙিন স্মৃতি মিশে আছে। সারাবছরের অপেক্ষা, পুজো কবে আসবে! চটি থেকে ফিতে দেওয়া জুতো পরে পুজো কাটানোর মজা, পাড়ার ছোট্ট দোকান থেকে বড়ো দোকানে মানুষের ভিড়; এমন কিছু ফেলে আসা সময়কে ভাবতে ভাবতে চোখে পড়বে ঘটাদাদুকে। কেন যে ঘটাদাদু, তার উত্তর জানেন না লেখক। তাঁদের বাড়ির সকলের জুতো তৈরি করতেন সেই ঘটাদাদু। কোনো ক্যাটালগ বা স্যাম্পল ছাড়াই দাদুর ইচ্ছেমতো ডিজাইনের জুতোয় পায়ে পায়ে কত আনন্দ! বয়স বাড়ে, বাড়ে শহর। সময়ের নিয়মে একদিন এল ‘ভারত শু’। ঝলমলে বাহারি শো-রুমের ডিজাইন। মনের মতো কত রকমফের! এরপর আস্তে আস্তে আরও বড়ো দোকান, শপিং মল। অনলাইনে জুতো দেখা এবং জুতো কেনা। হঠাৎ কোনো এক সময় অমৃতসরের এক বাজারে ভিন্ন মানুষের সঙ্গে নিজের জুতোর মিল খুঁজে পাওয়া। মনে পড়ে যায় সেই ছোটোবেলার কথা, “ঘটাদাদুর হাতে বানানো জুতোর ফোসকার দাগ এখনও কি লেগে নেই?” সেই ঘটাদাদুর দোকান আর নেই, জমি চলে গেছে প্রমোটারের হাতে। এ-পাড়া ও-পাড়ায় থাকা আমাদের এমন অনেক ঘটাদাদুর দোকান হারিয়ে গেছে। পাঁচতারা মল আর বাহারি ব্র্যান্ডের রোশনাইয়ে কেনই বা ঘটাদাদু আর ভারত শু-র জুতো কিনব আমরা? আধুনিক সময়ের পুজোয় ঠাকুর দেখতে গিয়ে পায়ে ফোসকা পড়া চলবে না কিছুতেই। আরও নতুন দোকান বাড়বে, বাড়বে রঙিন জুতো, পুজো আসছে।

এমন স্মৃতিমেদুর আখ্যানের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে থেমে দাঁড়াতে হবে একটি শিরোনামে, খেলনানগর। মেক্সিকোর দক্ষিণে একটি দ্বীপ, সেই দ্বীপে ভেসে আসে এক বালিকার দেহ ও পুতুল। প্রতিরাতে দ্বীপে পাওয়া যায় কিছু পদচিহ্ন। রাতে এক অচেনা ডাক। এরপর গোটা দ্বীপজুড়ে অসংখ্য পুতুল আনতে শুরু করেন জুলিয়ান সানতানা, দ্বীপটির কেয়ারটেকার। এই সব পুতুলেরা সেই বালিকার খেলার সঙ্গী। ক্রমশ দ্বীপটি হয়ে উঠল পুতুলদ্বীপ, আইল্যান্ড অফ দ্য ড‌ল্‌স। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর একদিন সেই জুলিয়ানের মৃতদেহ পাওয়া গেল দ্বীপে। মৃত বালিকা আর সেই ভেসে আসা পুতুলের পাশেই পাওয়া গেল জুলিয়ানের দেহ। এমন ঘটনা অলৌকিক, অতিপ্রাকৃত মনে হতে পারে। কিন্তু এমন খেলনানগর তো আমাদের সকলের যাপনে মিশে থাকে! এমন কোনো পাড়ায় কাটানো শৈশব নিশির ডাকের মতন ডেকে যায় কতজনের জীবনে! কোনো পুরনো সিনেমাহল অপেক্ষায় থাকে, কবে তার জীর্ণ শরীর ভেঙে উঠবে বহুতল। তারপর মাল্টিপ্লেক্সের এসি আর পপকর্নে সিঙ্গল স্ক্রিনের কুড়মুড়ে আলুর চিপস-বাদামভাজার কঙ্কাল আর্তনাদ করবে! আমাদের সকলের এমন অনেক খেলনানগর আছে, থাকে। তাদের কাছে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। যা ছেড়ে আসি, তা ছেড়ে থাকতেই হয় কখনো কখনো।

‘নিঃস্ব মফঃস্বলের দিনলিপিরা’ এমনই বহু গল্প বলে আমাদের। সে গল্প আমাদের পরিচিত তবে পরিচিত বিষয়-বস্তুও সময়ের স্তরভেদে নতুন হয়ে ওঠে। এমন বহু কিছু যা আর কোনোদিন ফিরে পাব না জেনেও ফিরে পেতে মন চায়, তার কাছে নিয়ে যায় এই বই। যে কোনো মুহূর্তে এর প্রতিটি লেখা মনে হয় নিজের কথা, নিজেদের কথা। লেখা যেন আরও বেশি কথা বলে স্কেচের টানে। হিরণ মিত্রের স্কেচ লেখাদের সজীব করে জীবন্ত। ছেড়ে আসা এমন কিছু, যা বারবার ফিরে পেতে চাই আমরা, তেমনই কিছু ছবি, আপাত সাধারণ কিন্তু গভীর। সে সব ছবির কাছে পৌঁছোতে শিল্প সমালোচক হতে হয় না। লেখা এবং ছবি যেন পরস্পর চলে হাত ধরাধরি করে। আকস্মিকতার সঙ্গে যাঁর প্রেম, অপরিণত-অর্বাচীন ফুলের প্রতি যার ঋণ সীমাহীন তিনি ফিরে যেতে চান সেই মাটির ঘরে, যার দেওয়ালে লেগে আছে ঘুঁটের ছাপ। ফিরে যেতে চান পাঠক, যার কোনো একদিন একটা মফঃস্বল অথবা শহর ছিল, সেইখানে কাটানো কিছু শৈশব-কৈশোর ছিল অমলিন।  

Spread the love

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *