Menu Close

অফ স্টাম্পের বাইরে: সপাট স্কোয়ার কাট

অভিনন্দন মুখোপাধ্যায়

সেপ্টেম্বর ২০২৫ | September 2025

বিভাগ

বুক রিভিউ

১. সীমানা ভাঙার আখ্যান

২. ‘সব গদ্যই মেলানকোলিক’ অথবা অন্য রকম কিছুও – একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া

৩. ভারতীয় ভক্তিসাহিত্য এক গুরুত্বপূর্ণ পুনঃপ্রকাশ

৪. অফ স্টাম্পের বাইরে: সপাট স্কোয়ার কাট

বই: অফ স্টাম্পের বাইরে
লেখক: গৌতম ভট্টাচার্য
প্রকাশনা: দীপ প্রকাশন
প্রচ্ছদ: একতা ক্রিয়েটিভ টেলস
দাম: ৪০০ টাকা
ISBN: 978-93-94432-93-2

শচীন তেন্ডুলকার সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন ক্রিকেটারদের বিখ্যাত সব উক্তি আছে। তার মধ্যে ‘শচীন গ্রেটেস্ট’, ‘শচীন অসাধারণ’ এসব উক্তি তো আছেই, কিন্তু ব্রেট লি-র কথাটি বেশ অন্যরকম। ব্রেট লি বলছে ‘তুমি অফস্টাম্পে বল ফেলে ভাবছো এটা বেশ ভাল বল করলাম। কিন্তু ও অনায়াসে মিড উইকেটে বলটাকে মেরে দু’রান নিয়ে নেবে। ওর ব্যাটটা ভীষণ ভারি, কিন্তু ও ব্যাটটাকে টুথপিকের মতো ব্যবহার করে।’

শচীন না হয় ব্যাটকে টুথপিকের মতো ব্যবহার করতেন, কিন্তু সাংবাদিকতার কঠিন বাউন্সি পিচে যিনি কলমকে প্রায় টুথপিকের মতো ব্যবহার করেছেন  তিনি গৌতম ভট্টাচার্য। তাঁর ‘অফ স্টাম্পের বাইরে’ পড়তে পড়তে বারংবার চমকে উঠেছি, কারণ যে সমস্ত রসদ তিনি বইয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছেন তাতে অনায়াসে বইটিকে সাংবাদিকতার নোটবুক বলা যায়। অন্তত নব্য সাংবাদিককূলের একবার এই বইটি পড়ে দেখা উচিত৷ শিখে রাখা উচিত, যখন একের পর এক আনপ্লেয়েবল ডেলিভারি ধেয়ে আসে তখন ঠিক কীভাবে স্নায়ুর উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হয়। কীভাবে বিখ্যাত লোকেদের কনভিন্স করতে হয়।

বইটির ভূমিকা থেকেই আপনার মাইন্ডসেট তৈরী হবে আপনি ঠিক কী পড়তে চলেছেন — ‘সাংবাদিক জীবনে একটাই দৃপ্ত শপথ অক্ষুণ্ণ রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় থেকেছি। কখনো গল্পদাদুর আসর বসাইনি। যেটুকু পৌঁছেছি, যেটুকু দেখেছি আপসহীন তা-ই লিখেছি। বলেছি।’ মোট ৫১ টি নাতিদীর্ঘ লেখায় উনি এই বইয়ে তার জার্নি, দেখা, মনন, চিন্তন, অভিজ্ঞতা ঢেলে দিয়েছেন। এখনকার সোশ্যাল মিডিয়া সর্বস্ব ইনফ্লুয়েন্সারদের জমানায় আমার বারংবার মনে হয়েছে ‘অফ স্টাম্পের বাইরে’ আসলে একটি আকাটা হীরে যাকে সোনা খুঁজতে গিয়ে আমরা হয়তো ততটা সম্যক গুরত্ব দিয়ে উঠতে পারিনি। এই বইয়ে ক্রিকেট, সিনেমা ও অনান্য জগতের বিখ্যাত মানুষদের যে সমস্ত উক্তি উনি তুলে ধরেছেন তা পড়লে মোটিভেটেড না হওয়াটাই আশ্চর্যের। যেমন, ২০০৩ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা-অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনাল ভারতের সব প্লেয়াররা দেখছে। হঠাৎ লেখক আবিষ্কার করলেন এলেঙ্গানি হোটেলের লবিতে ভারতের সহ-অধিনায়ক রাহুল দ্রাবিড়। বাকিটা জানা যাক লেখকের লেখা থেকেই—

অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলাম, “কী ব্যাপার? আপনার উচাটন হচ্ছে না ওখানে কী চলছে?”

দ্রাবিড় এমন একটা উত্তর দিয়েছিলেন, যা হালফিল ম্যানেজমেন্টের বইয়ে দেখতে পাই। কিন্তু আজ থেকে কুড়ি বছর আগে কারো মুখে শুনিনি। বলেছিলেন, “হচ্ছে। কিন্তু বেশি ভেবে লাভটা কী? আমি বিশ্বাস করি, জীবনে যা কন্ট্রোল করতে পারবেন না, তা নিয়ে অনর্থক ভাববেন না।” জীবনের যে কোনো অবস্থায় এই দর্শন আপনাকে সাহস জোগাবে।

এই বইয়ের প্রথম লেখা ‘কিছু ছবি কিছু কথা কিছু নীরবতা’-য় শ্রী ভট্টাচার্য লিখছেন ‘এক একজন পেশাদার জীবনকে এক একরকম দেখে। অনেক সাংবাদিককে আমি চিনি যারা রক্ষণশীলতায় চূড়ান্ত বিশ্বাসী। সতর্ক। সনাতনী। এই শহরে ম্যাচ বা ইভেন্ট কভার করতে গেলেও যারা ঘটনা থেকে চোখ সরিয়ে তাদের কলমের ক্যামেরা কাশীর গলিতে ঢোকাতে চাইবে না। আমি সেই মডেলে কখনো ভোট দিইনি। বরাবর নতুন পতাকা ওড়াতে চেয়েছি। যা বিশ্বাস করে, মাঠের খেলা মানে শুধুই মাঠের খেলা নয়। তাকে ঘিরে থাকা ব্যক্তিগত জীবনের খেলা। সেই শহরের চারিত্রিক বৈশিষ্টের খেলা। সেই শহরের মানুষ আর তার নিয়মিত আগন্তুকদের মানসিকতার খেলা। পেশাদারের খেলা। আবার লোকেশনেরও খেলা।’ বারাণসী শহরের বহুবর্ণ চরিত্র সম্পর্কে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করতে গিয়ে এই ক’টি কথার অবতারণার মধ্যে লেখক নতুনের বিজয়কেতন ওড়ানোর সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে রাখছেন। ‘থ্রি ইডিয়েটস’ সিনেমায় আমির খান যখন ক্লাস নেওয়ার চাপে পড়ে ইয়ার্কি করছে বন্ধুদের নাম নিয়ে এবং তারপর বলছে, ‘কেউ আজ নতুন কিছু শিখবো এই মেন্টালিটি নিল না, সবাই রেসে লেগে গেল’ তখন লেখকের এই উক্তিকে মিলিয়ে নিলে কী অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। ছোটবেলায় যখন পেছনের পেজ দিয়ে খবরের কাগজ শুরু করতাম তখন মুখিয়ে থাকতাম আজ নতুন কিছু পড়বো, আর সেটা অবশ্যই নান আদার দ্যান শ্রী গৌতম ভট্টাচার্যের। বাংলা সাংবাদিকতায় এই নতুনত্বের আমদানির ফলে আমরাও বলতে পেরেছি বা পারি যে তোমাদের যদি নেভিল কার্ডাস, পিটার রোবাক থাকে আমাদেরও একজন গৌতম ভট্টাচার্য আছে৷ কিন্তু এই নতুনত্ব আমদানি করা নিয়ে লেখককে নানাবিধ ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, লেখকের নিজের কথায় জানা যাক ‘খেলা ও বিনোদনের লেখার কনটেন্ট ভাঙ্গাভাঙ্গি আর ইন্টারভিউয়ের স্টাইল বদলানো নিয়েও বছরের পর বছর কত টিপ্পনি শুনতে হয়েছে। পাত্তাই দিইনি। যে যার মতো। অফ স্টাম্পের বাইরের বল কেউ ছাড়ে। কেউ স্কোয়ার কাট মারে। কেউ আড়াআড়ি খেলে। কেউ শেহবাগের মতো তুলে দেয় মিড অফের ওপর দিয়ে।’ এবং বলতে দ্বিধা নেই এই বই পড়তে পড়তে বুঝেছি লেখক প্রায় প্রতিক্ষেত্রেই শেহবাগীয় স্টাইলই রক্ষা করেছেন।

এই বই লেখকের সাংবাদিক জীবনের একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতার রুমাল যেখানে বিভিন্ন সময় মুছে রাখা ঘামের গন্ধ মিলেমিশে আছে। ফ্রি-লান্সার হিসেবে ফুটবল বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে ব্ল্যাকলিস্টেড হওয়ার মতো সমস্যায় পড়া এবং সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়া কিংবা জিনাত আমনের ইন্টারভিউ করতে গিয়ে উইকিপিডিয়ার ফাঁদে পড়ে ‘ভুল’ প্রশ্ন দিয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে শুরু করার পর বিপদে পড়া এবং পুনরায় ইন্টারভিউয়ারকে বশ করে ফেলা, অথবা ব্রাজিলে বিশ্বকাপ কভার করতে গিয়ে ভুল করে সেক্স মোটেল বুক করে ফেলা—এরকম নানাবিধ ঘটনার ফার্স্টহ্যান্ড এক্সপিরিয়েন্স নিয়ে গড়ে উঠেছে এই বই।

কিন্তু এই বইয়ের আরেকটি অন্যতম ইউ এস পি সাংবাদিকদের জীবনে ক্রমাগত ফেস করে চলা নানাবিধ রাজনীতি। এই রাজনীতির নেতা-মন্ত্রীরা আসলে নিজের কলিগ। লেখকের নিজের জবানিতেই শুনি ‘সাংবাদিকদের দুনিয়া আসলে পুরোটাই ব্যাকরুম। সেখানে আলো-আঁধারিতে এমন সব অপরাধ সংঘটিত হতে দেখেছি, যা এককথায় ‘ক্রিমিনাল’। কিন্তু কে তার বিচার করবে? এখানে তো কোনো আদালত নেই। কোনো থানা নেই, যেখানে নির্বিরোধী সাংবাদিক তার বসের বিরুদ্ধে ‘এফআইআর’ করবে। কলকাতার ইংরেজি মাধ্যমের এক বিখ্যাত সাংবাদিকের শেষ ইন্টারভিউ বাকি সবাইকে হারিয়ে তেন্ডুলকর। ঠিক তার কদিন আগে বিলেত থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতি সরাসরি জোগাড় করা। অথচ এর কয়েকদিনের মধ্যে তাঁকে সরে চলে যেতে হয়েছে। কোম্পানি একদিনও এক্সটেনশন দেয়নি। ঠিক এই সারসত্য প্রমাণ করে যে, মিডিয়ার দুনিয়ায় পারফরমেন্স সবসময় শেষকথা নয়। কোনটা পারফরমেন্স আর কোনটা নয়- সেই বিচারপদ্ধতিই তো ঘোলাটে! পুরো বিচারটাই যে দুর্ভাগ্যক্রমে ‘সাবজেক্টিভ’।’ কিংবা আরেকটি অংশ পড়া যাক ‘প্রেস কার্ড আপনাকে হাফ লাইন অবধি ছাতা মাথায় এগিয়ে দেবে। কিন্তু তারপর দেখবেন, কী অদ্ভুত রহস্যে আপনার পুরো রাস্তা ঘুটঘুটে হয়ে গিয়েছে। কখনো ভয়ংকর ট্যাকলে দীর্ণ যন্ত্রণা সামলাতে সামলাতে আবিষ্কার করবেন, আরে, এ তো বিপক্ষ নয়। আপনার সিনিয়র সহকর্মী। দুটো ডেস্ক পাশে বসে কাজ করে। আপনার ‘সো কল্ড’ স্নেহশীল দাদা। কিন্তু দ্রুত বুঝবেন, কিছু করার নেই! সবাই গোল-মুখে ছুটছে। সবার গোল চাই। প্রোজেকশন চাই। বাজারে স্বীকৃতি চাই এবং তার জন্য একে অপরকে মাড়িয়ে যেতে চোখের পাতাও কাঁপবে না।’ এই পর্যন্ত পড়ে ভুল করেও ভাববেন না যে এটি শুধু লেখকের জীবনের অভিজ্ঞতা, ভাল করে মিলিয়ে দেখলে বুঝতে পারবেন আপনাকেও প্রতি মুহূর্তে, কর্মক্ষেত্রে অথবা সংসারে একই রকম রাজনীতির শিকার হতে হচ্ছে৷ আর যখনই এটি বুঝতে পারবেন, এই বই আপনার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠবে।

কিছু বই লেখা হয় শুধুমাত্র লেখার তাগিদে, আর কিছু বই নির্মাণ হয় পাঠককে ফেসবুকিয় ভাষায় ‘নাড়িয়ে’ দেওয়ার জন্য। এই বইতে শ্রী ভট্টাচার্য তাঁর দেখাগুলিকে যেভাবে উন্মোচন করেছেন তাতে বোঝা যায় সাংবাদিকতা বা ইন্টারভিউ করার ছলে শুধু রিপোর্টিং করেই থেমে যাননি, শুধু মাঠ নয়, ড্রেসিংরুমের অগম্য স্থানেও গমন করেছেন দৃঢ় ভাবে। খেলাকে ৩০ শতাংশ দিয়ে বাইরের খবর রেখেছেন ৭০ শতাংশ। এই স্টাইলের একটা নামকরণও করেন – টুটিফ্রুটি। এই নতুন স্টাইলাইজেশন বাংলা সাংবাদিকতাকে বেশ কয়েকগুণ এগিয়ে দিয়েছিল সে নিয়ে সন্দেহ নেই। ইংরেজি ভাষায় ‘আনপুটডাউনেবল’ এই বইয়ের সামগ্রিক নির্যাস ধরা আছে একটি লেখার অংশে ‘ …ক’জন বোঝে যে সাংবাদিককেও অদৃশ্য ব্যাট নিয়ে তার কভারেজের পিচে নামতে হয়? অফ স্টাম্পের বাইরের সেই চির অনিশ্চয়তার করিডোরে সে-ও নিয়মিত বিভ্রান্ত, কখনো হতাশ, কখনো বিপন্ন, কখনো পরাজিত আবার কখনো জয়ীও হয়। আর সেই সব কিছুর পেছনেই থেকে যায় চেঞ্জিং রুমের গোপন কাহিনী…’’।

বিখ্যাত ক্যারাবিয়ান ক্রিকেট লিখিয়ে আই এল আর জেমস বলেছিলেন ‘তারা ক্রিকেটের কী বোঝে যারা শুধুই ক্রিকেট বোঝে?’ এই উক্তিটিকে একটু ঘুরিয়ে বলা যায় ‘তারা সাংবাদিকতার কী বোঝে যারা শুধুই সাংবাদিকতা বোঝে?’

‘অফ স্টাম্পের বাইরে’ ছত্রে ছত্রে সাংবাদিক জীবনের উত্থান-পতন, সৃষ্টি-বিনাশ, মুহূর্তকে ধরে রেখেছে সর্বস্ব দিয়ে।

Spread the love

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *