Menu Close

সীমানা ভাঙার আখ্যান

শ্রীজিৎ সরকার

সেপ্টেম্বর ২০২৫ | September 2025

বিভাগ

বুক রিভিউ

১. সীমানা ভাঙার আখ্যান

২. ‘সব গদ্যই মেলানকোলিক’ অথবা অন্য রকম কিছুও – একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া

৩. ভারতীয় ভক্তিসাহিত্য এক গুরুত্বপূর্ণ পুনঃপ্রকাশ

৪. অফ স্টাম্পের বাইরে: সপাট স্কোয়ার কাট

বই: হুবারা বাস্টার্ড
লেখক: সুতপা বসু
প্রকাশক: প্রতিভাস
প্রচ্ছদ: প্রীতম দাশ
দাম: ২০০ টাকা
ISBN: 978-93-92435-38-6

২০১৬ সালে বিবিসি’র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিবেদন। তার আদলটি যদিও ছিল পরিসংখ্যানে ঠাসা প্রাণিসংরক্ষণমূলক প্রবন্ধের, তবে মধ্যপ্রাচ্যীয় গণমানসের বর্তমান রূপরেখাটিও যথেষ্ট স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল সেখানে। লেখাটিকে কাটছাঁট করলে দুটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যাবে:

১। আরবের সম্ভ্রান্ত পুরুষরা (বিত্তশালী শেখ, রাজপরিবারের সদস্য প্রমুখ) হুবারা বাস্টার্ড নামক বিপন্ন পাখিটি শিকার করেন যে দুটি কারণে—তার একটি যদি হয় নিখাদ শিকারক্রীড়ার আনন্দলাভ, তবে অন্যটি অবশ্যই তার মাংসের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ‘কামোদ্দীপক’ (এবং অবশ্যই যৌনশক্তিবর্ধক) বিশেষণটির জন্য।

২। বছরের কোন সময়ে হুবারা বাস্টার্ড শিকার করা যাবে, কতদিনের জন্য অনুমতি বহাল থাকবে, সর্বোচ্চ কতগুলি পাখি হত্যা করা যাবে ইত্যাদি বিষয়ে সরকারি তরফে কিছু বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও, সেসবকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে নিয়মিত সেখানে চলে যথেচ্ছ নিধনযজ্ঞ। সেইসঙ্গে চোরাচালান এবং চোরাশিকারের মতো ঘটনাগুলি তো ঘটেই থাকে।

এখানেই পুনরাবির্ভাব ঘটে কয়েকটি পুরনো প্রশ্নের: উন্নয়ন নামক প্রদীপটির নীচে কি তবে অবদমিত রিপুতাড়নার আদিম ছায়াটি প্রগাঢ় হওয়া বাধ্যতামূলক? নাকি উন্নয়ন এবং অবনয়ন বাস্তবে সমান্তরাল এবং বিপ্রতীপ দুটি ধারা, যাদের সহাবস্থানই সভ্যতার মূল চালিকাশক্তি?

যে কোনও সাহিত্যকর্ম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হওয়া উচিত নাকি অনুচিত, সে বিষয়ে ব্যক্তিভেদে মতান্তর থাকতেই পারে। তবে আলোচ্য উপন্যাসের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে দেখা যায় যে গ্রামটিকে—সেখানকার বাসিন্দাদের কৃষিকাজ করার পাশাপাশি হুবারা বাস্টার্ডের চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত থাকার প্রসঙ্গটি যে কেন একটি গুরুত্বপূর্ণ দ্যোতনা হয়ে উঠেছে—তার সাক্ষ্য বহন করে উপরের প্রশ্নগুলি। যদিও, একদিকে ক্ষমতাবানের আদিম শখ এবং সেটি পূরণের জন্য প্রতিপত্তির প্রয়োগ, আর অন্যদিকে সিদ্ধিলাভের মাধ্যম হিসাব অপেক্ষাকৃত পশ্চাদবর্তীদের নৈতিকতা-অনৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে স্বতঃপ্রণোদিত যোগদান এবং যে কোনও প্রকারে নিজেদের অর্থনৈতিকভাবে আরেকটু স্বাবলম্বী করে তোলার মরিয়া প্রচেষ্টা—আর্থ-সামাজিক প্যারামিটারের নিরিখে সম্পূর্ণ ভিন্ন দুই শ্রেণীর বাসিন্দাদের মধ্যে মিথোজীবিতার চিরাচরিত দৃশ্যের পরিস্ফুটকরণেই সীমাবদ্ধ থাকেনি উপন্যাসটি।

কাহিনির আরম্ভ শামিম নামক কিশোর চরিত্রটির মাধ্যমে হলেও, ক্রমে গল্পের ভরকেন্দ্র হয়ে ওঠে তার অগ্রজ সহোদরা শাইমা; এবং একসময় তাকে ঘিরেই আবর্তিত হয় ঘটনাপ্রবাহ। মূলত তার জীবনের উত্থান-পতন, অতীত-বর্তমানের আনাগোনা, শারীরিক এবং মানসিকভাবে পরিণতিলাভ এবং পারিপার্শ্বিকের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিই স্বস্কন্ধে তুলে নেয় গল্পের আত্মাকে বহন করার দায়। প্রাথমিকভাবে এটিকে উপন্যাসে নারীকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যের আরোপজনক উপাদান মনে হলেও, পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এর মাহাত্ম্য। বিশেষত, নিজের মা’কে নিয়মিত পরিবারের সদস্যদের কাছে বিবিধভাবে লাঞ্ছিত হতে দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, মূলত ‘কন্যাসন্তান’ পরিচয়টির জন্যই স্বাভাবিক অতিইচ্ছাপূরণের (যেমন – লেখাপড়া শেখা) ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হওয়া এবং চূড়ান্ত রক্ষণশীল (ও পুরুষতান্ত্রিক) সমাজে নারীর সামগ্রিক অবস্থান ও জীবনসংগ্রাম তার ব্যক্তিগত জীবনদর্শনে যেভাবে প্রতিভাত হয়—তা যে শামিমের দৃষ্টিকোণ থেকে যথার্থভাবে বিশ্লেষিত হওয়া সম্ভব ছিল না, সে কথা স্বীকার করা চলে দ্বর্থ্যহীনভাবে।

আদর্শ উপন্যাসের নিয়ম মেনেই, ক্ষীণতনু এই উপন্যাসটিরও বাঁকবদল হয় বেশ কয়েকবার। ঘটনাচক্রে হারিয়ে যাওয়া ভাইকে খুঁজতে গিয়ে আফরোজের সন্ধান পাওয়া এবং তার প্রতি প্রেমজ আকর্ষণে অনুরক্ত হয়ে পড়া যেমন শামিমের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তরের অনুঘটক হয়ে ওঠে—তেমনই হুবারা বাস্টার্ড প্রতিপালন শিখতে গিয়ে চোরাচালান বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত হয়ে পড়ার পর্বটি যেন নিত্যনৈমিত্তিক জীবনধারণ আর মানবিক উত্তোরণের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করে।

ঘটনামালায় রাজনীতির প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ নিঃসন্দেহে উপন্যাসটির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। আন্দোলনের অন্যতম মুখ হওয়া থেকে শাইমার ক্রমে পঞ্চায়েতব্যবস্থার অংশ হয়ে ওঠা যে শুধু অবদমিতের ক্ষমতায়ন বা যোগ্যতমের উদবর্তনকেই মান্যতা দেয়, তা নয়—বরং, আদ্যোপান্ত পুরুষশাসিত সমাজে এক নারীর বৃহত্তর ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠার যাত্রাপথটিকেও চিত্রিত করে। সেইসঙ্গে গ্রামীণ রাজনীতির মূল অন্ধকার রূপটি উন্মচোন করার প্রয়াসও যথেষ্ট প্রশংসার দাবী রাখে।

সুতপা বসুর উপন্যাসটির প্রেক্ষাপট মধ্যপ্রাচ্যের অজ্ঞাত-পরিচয় কোনও গ্রাম। তার নাম বা অবস্থানের বিন্দুমাত্র উল্লেখ গোটা বইয়ের কোথাও পাওয়া যায় না। হয়তো বাসিন্দাদের জীবনযাত্রা এবং সমাজচিত্রের বিস্তারিত আলেখ্যটিতেই লেখক সুস্পষ্ট করে দিতে চান তার ভৌগোলিক পরিচয়। তবে, সেসব প্রশ্ন একসময় মূল্যহীন হয়ে পড়ে উপন্যাসটির সার্বজনীন প্রাসঙ্গিকতার কাছে।

আদপে এই আখ্যান কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলের নয় (উল্লেখ্য, হুবারা বাস্টার্ডকে অনায়াসে প্রতিস্থাপিত করা যায় আমাদের দেশের বনরুই বা তক্ষক দিয়ে; কিংবা গ্রামটিকে কল্পনা করে নেওয়া যেতেই পারে উত্তরপ্রদেশ অথবা রাজস্থানের কোনও প্রত্যন্ত অঞ্চল হিসাবে), কোনও নির্দিষ্ট জনজাতি বা ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নয়। অসাম্য, বঞ্চনা, ধ্বংস, রিপুর তাড়না, লিঙ্গ রাজনীতি এবং পারিপার্শ্বিকের ঢেউয়ে ভেসে আলো-আঁধারির কক্ষপথে আবর্তিত হওয়ার যে পর্যায়ক্রমিক পালাবদল চলে আসছে মানবসভ্যতার আদিকাল থেকে—তাকেই যুগোপযোগীতার আতসকাচের নীচে আরেকবার বিশ্লেষণ করা যায় পাঠাভিজ্ঞতায় জারিত হতে হতে। হয়তো তাইজন্যই শামিম আর আফরোজের প্রণয়পর্বের বন্ধুর যাত্রাপথ যেমন উদ্বেল করে আশঙ্কার জাহাজটিকে, তেমনই নারীর চূড়ান্ত পরিণতিগুলির আসন্ন সম্ভাবনা জাগিয়ে তোলে অস্তিত্ব সংকটের প্রশ্ন।

হয়তো এই একাত্মবোধকে বিঘ্নিত না করার স্বার্থেই, কাহিনির হৃদয় পর্যন্ত পৌঁছানোর পথটিকে লেখক সচেতনভাবে দুরূহ করে রাখেননি। বরং সাবলীল গদ্যে তিনি বুনেছেন গল্পের জাল; ঘটনাপ্রবাহকে দিয়েছেন গতিময়তা এবং বেশ কিছু রোমাঞ্চকর মুহূর্তের অলংকার। যদিও বিষয়বস্তু সর্বোতভাবে যে ব্যপ্তি দাবি করে, সেই পথে এই গতি এবং আয়তন অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় কখনও কখনও; চরিত্রদের আনাগোনা এবং ঘটনার পর্যায়ক্রম—উভয়েই আপাতভাবে কিছুটা একরৈখিকতার দোষে দুষ্টও। বিবিধ উত্তোরণ এবং রূপান্তর—যাদের কাঁধে চেপে গল্প পৌঁছিয়েছে অন্তিম গন্তব্য পর্যন্ত—তারা আরও বিস্তারিত পরিসরের দাবি করে। তবে লেখকের উপমার ব্যবহার বহুব্যবহৃত হলেও, প্রয়োগগুণে যথেষ্ট অভিঘাতী হয়ে ওঠে (যেমন: দীর্ঘদিন পর দুই চরিত্রের সাক্ষাৎকে তিনি বর্ণনা করেছেন অনাবৃষ্টি শেষে হওয়া বর্ষণের সঙ্গে—যা একদিকে যেমন সুচিত করে অপেক্ষার অবসানকে, তেমন রুক্ষ্ম ভৌগোলিক পটভূমিতে বৃষ্টির প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে প্রশান্তির চিত্রকল্প)।

সব শেষে প্রশ্ন উঠতেই পারে: এই কাহিনি কি কেবলই প্রাণীসংরক্ষণের ইতিবৃত্ত? প্রথাভাঙার গাথা? নাকি পরিবেশসচেতনতার ছদ্মবেশে নারীবাদ বিস্তারের গোপন কৌশল?

এই উত্তরটি দেওয়া শক্ত। কারণ, এই উপন্যাস আদপে নিজেই একটি প্রশ্ন রেখে যায় শেষপর্যন্ত। অগ্রগতির রথ দুরন্তবেগে ছুটে চলা সত্ত্বেও, অনগ্রসরতাও কি আদপে ধ্রুবক এক উপাদান মাত্র? নাকি সভ্যতার তথাকথিত ধারক-বাহকরাই একে অপরিবর্তিত রেখে দিতে চান নিজেদের স্বার্থে? প্রশ্নকর্তার পরিচয় যা-ই হোন না কেন, উত্তর অনুসন্ধানের দায় কিন্তু সকলের।

Spread the love

Related Posts

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *