সেপ্টেম্বর ২০২৫ | September 2025

বিভাগ
বুক রিভিউ
২. ‘সব গদ্যই মেলানকোলিক’ অথবা অন্য রকম কিছুও – একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া
৩. ভারতীয় ভক্তিসাহিত্য এক গুরুত্বপূর্ণ পুনঃপ্রকাশ
৪. অফ স্টাম্পের বাইরে: সপাট স্কোয়ার কাট
* * * * * *

বই: সব গদ্যই মেলানকোলিক
লেখক: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
প্রকাশনা: সৃষ্টিসুখ
প্রচ্ছদ: অনির্বাণ ভট্টাচার্য
দাম: ২২৫ টাকা
ISBN: 978-93-89953-95-4

‘মেলানকোলিক’ (Melancholic) শব্দটির উপস্থিতিই এক নিবিড় বিষাদ অনুভূতির দিকে এক পা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া, বা দিগদর্শন। কোনোভাবে পাঠককে একটা মানসিক প্রস্তুতির দিকেই নিয়ে যাওয়া। কনক্লিউডিং বিফোর রিচিং দ্য কনক্লিউশন, অলরেডি সাজেস্টেড প্রিভিউ—সব গদ্যই ‘মেলানকোলিক’।
লার্স ভন ট্রায়ারের ‘মেলানকোলিয়া’ সিনেমায় জাস্টিন চরিত্রটির মুখে এমনই এক জাজমেন্টাল কনক্লিউশন আছে— ‘The earth is evil. We don’t need to grieve for it.’
তাই একপ্রকার সচেতনভাবেই এই নাম দিয়ে যে উপস্থাপিত করা বা পরিচয় করিয়ে দেওয়া, তাকে সচেতনভাবেই একটু বিভাজিত করে রাখা দরকার। ‘সব গদ্য’ এবং ‘মেলানকোলিক’।
আমরা এই ‘সব গদ্য’-র দিক থেকে শুরু করি।
গদ্যকার অনির্বাণ ভট্টাচার্য তাঁর এই গদ্য সংকলনটি সাজিয়েছেন চারটি পৃথক বিভাগে—
- যা কিছু আজ ব্যক্তিগত
- ঋণী তত করেছ আমায়
- কীরকম আছে মানুষেরা?
- চারদিকে এত খেলা!
প্রত্যেকটি নামকরণই একপ্রকার লিফাফার মতো, যা থেকে বোঝা সম্ভব কেন গদ্যগুচ্ছ পাওয়া যাবে সেই লিফাফা খুললে। এবং প্রতিটি লিফাফাতেই মুখবন্ধের মতো সাজেস্টিভ কোটেশনের প্রশংসনীয় ব্যবহার। যা একপ্রকার ক্রমে হেলে যেতে থাকে সেই প্রিডিফাইনড বিশেষণের দিকে—মেলানকোলিক। মনকে প্রস্তুত করে রাখতে চায়, আসন্ন মৃদু দুঃখ অথবা নিবিড় অবসাদের জন্য। ২০১৫ থেকে ২০২২, এই সময়কালে লেখা বিভিন্ন বিষয় এবং ব্যক্তিগত অনুভূতি/প্রতিক্রিয়াভিত্তিক গদ্যগুলো ক্রোনোলজিকালি সাজিয়ে রাখা এক একটি সেগমেন্টে।
যা কিছু আজ ব্যক্তিগত… শুরুই হচ্ছে ‘ব্যক্তিগত সিরিজ’ দিয়ে… সম্ভবতঃ এই বইয়ের সব থেকে ভারী এবং গভীর গদ্য সংকলনের সেগমেন্ট এইটিই। সলিলকি, দেখা, বিপন্নতা, রাস্তা(অথবা যাত্রাপথ), সিলভিয়া, চন্দরা… ‘চমৎকার জুলেখা ডবসন’। পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হতে পারে এই সেগমেন্ট নিজেই ভীষণ অটোনমাস, এবং এখানেই বইয়ের নামকরণের সার্থকতা কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। অথচ এই সেগমেন্টের ঘিরে ধরা আবহসংগীত… চেলোর বেস-কে অতিক্রম করে পাঠককে গা ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে।
‘ঋণী তত করেছ আমায়’ পরিচয় করে দেবে কিছু ব্যক্তি, ঘটনা এবং তৎসংলগ্ন বিষয়গুলির সঙ্গে… প্রভাব অথবা প্রভাবিত। এবং সেই রেশ রেখেই এগিয়ে চলে ‘কীরকম আছে মানুষেরা?’ কৃষক আত্মহত্যার মতো একটি গম্ভীর বিষয়কে নিয়ে চলতে শুরু করেই একের পর এক এমিনেন্ট এবং রেলিভেন্ট ক্রাইসিসের সঙ্গে পরিচয় করে দিতে থাকে। শ্রমিক মৃত্যু, গণশত্রুদের চিহ্নিত করণের আহ্বান, খুব বলিষ্ঠভাবে নিয়ে আসা কিছু প্রশ্ন এবং অভিয়াস অবজার্ভেশন… যা এড়িয়ে যাওয়া বা ভুলে যাওয়া যায় না। পাঠকের মধ্যে তা সঞ্চারিত হোক, অনুরণন ঘটাক। এটাই সব থেকে বড়ো ‘টেক অ্যাওয়ে’ মনে হয়। ২০১৪ পরবর্তি ভারতবর্ষে যা কিছু অবক্ষয় এবং অবনতি, তাও স্পষ্ট প্রতিফলিত হয় কিছু গদ্যে। আসছে ২০২০-২০২১-এর অতিমারীকাল। মেলানকোলিকে অতিক্রম করে স্পষ্ট হয়ে ওঠে এক সচেতন নাগরিকের রেজিস্টেন্স, প্রতিরোধের প্রয়াস, নিজস্ব সামর্থ্যে।
এই দুটি সেগমেন্টের বিষয়, একেবারেই ‘মুভ অন’ করে এগিয়ে যাওয়ার মতো নয়। আবারো বিরাম নিতে হয়। এদের রেশ কিছুটা থিতিয়ে নিতে। আবারো মনে হয়… মেলানকোলিতে না বেঁধে এদের হয়ত পৃথক সত্তা দিয়ে মুদ্রিত করা যেত। সব গদ্য তো মেলানকলিক নয়… পাঠককে পাঠপূর্ব অ্যাজামশন থেকে মুক্ত হতে হবে।
শেষে আসে ‘চারদিকে এত খেলা!’
ক্রীড়াভিত্তিক প্রবন্ধ না হয়ে, এই সেগমেন্টের এসেগুলি একের পর এক গদ্য যা ছুঁয়ে থাকে ক্রীড়াপ্রেমীর ব্যক্তিগত আবেগ, ব্যক্তিগত ক্ষতি, জয়-পরাজয়… ‘খেলা’ শব্দটিকে এখানে এক তীব্র মেটাফোর। একটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হল, এখানে এসে বেশিরভাগ গদ্যই পড়তে পড়তে মনে হবে পত্র। এবং অনেকের শেষও হয়েছে ‘ইতি’ দিয়ে। ব্যারেটো, হান্সি বা ফেডারারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আবেগকে পুনরাবিষ্কার করার পাশাপাশি একটি পাঠক প্রজন্ম পরিচিত হবেন সঞ্জীব দত্ত এবং উমাকান্ত পালোধির মতো নামের সঙ্গেও। মনে পড়বে, জানতে পারবেন… জড়িয়ে থাকা/রাখা ঘটনাগুলি।
নিবন্ধ বা ‘পত্র’গুলি ক্রীড়া জার্নালের প্রচলিত/পরিচিত ধারা থেকে সরে এসে অনেকটাই আবেগাশ্রিত বলেই হয়ত তাকে গদ্য বলে এই সংকলনে রাখা যায়। বা, রাখার সচেতন সিদ্ধান্ত। অথচ তিনটি সেগমেন্ট পার করে এসে, এখানেও মনে হয়… কেবল ‘মেলানকোলিক’ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েই হয়ত এরা এখানে। নাহলে এই গুচ্ছও অটোনমাস। একেবারে স্বতন্ত্র পাঠ অভিজ্ঞতা। ‘সব গদ্যই মেলানকোলিক’, এই বইয়ের গদ্য-সেগমেন্টগুলি পড়তে পড়তে মনে হয় এ এক পরিবেশিত প্ল্যাটার। ‘যা কিছু আজ ব্যক্তিগত’ যদি পাঠকের মন ওভারহোয়েল্ম করে দেয়, এর পর এগোতে এগোতে আরো বেশ কিছু গদ্যের মধ্যে প্রিডমিন্যান্টলি মেলানকলির রস অনুভূত হবে। অথচ, তাকে সরিয়ে রাখলে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিভাগের প্রকাশ এবং প্রতিরোধ মেলানকলিকে ছাপিয়ে যায়। এমনকি ‘খেলা’ মেটাফোরের আড়ালেও একটা আবেগপূর্ণ ক্ষোভ মাথা তোলে স্থানে স্থানে। আদৌ ‘সবটাই মেলানকোলিক’ কি না, পাঠকের নিজস্ব অনুভূতি… ব্যক্তিগত পাঠ অভিজ্ঞতা। কিন্তু একের পর এক রেফারেন্স এবং উদ্ধৃতির সচেতন প্রয়োগ, বেশ কিছু ব্যক্তিত্বের উল্লেখ, ঘটনার উত্থাপন… এই বইকে একটি আলাদা মাত্রা দেয়। তাঁদের সম্পর্কে, সেই ঘটনা সম্পর্কে আরো জানার ইন্ধন দিয়ে রাখে। পাঠক নিজেও তো একপ্রকার মানসিক স্থিতির মধ্যে থাকেন? যেমন ম্লান জ্যোৎস্নাও জ্যোৎস্না… নাইট ল্যাম্পের আলোও আলো… One doesn’t need to agree, or reconcile, but keeping the window open is more important… so is acknowledging. বইয়ের ব্লার্ব-এ যেমন লেখা ‘শেষমেশ পাথরটা কিন্তু ঠেলতেই হবে।’ ‘The earth is evil,’ জাস্টিনের এই কথাগুলো শুনে মনে প্রশ্ন জাগে… পৃথিবীই কি ‘evil’? আদৌ পৃথিবী কি ‘evil’? যা বিপুল ক্ষতি করার মানুষ করে চলেছে। বিগত একশ বছরেই উন্নতির নামে যা ক্ষতি হয়েছে, বিংশ শতাব্দীর পূর্বে মানব সভ্যতার ইতিহাসে তা হয়নি। এবং এখনো, এই সকল ক্ষতির চেষ্টাকে জাস্টিফাই করে সব দিক থেকে সব কিছু নর্মালাইজ করে দেওয়ার চেষ্টা চলছে… কিছুতেই কিছু আসে যায় না এই ‘evil’ নেক্সাসের। আবার এও সত্য… একটা ‘ওয়াইপ আউট’ করে সব কিছু মুছে দেওয়া বিশ্বপ্রকৃতির কাছে ‘বায়েঁ হাত কা খেল’।
এও সত্য… চেরনোবিলের ভয়ংকর তেজস্ক্রিয় মেল্ট ডাউনের পরেও, সেখানে প্রকৃতি নিজের মতো করে দখল করে নিয়েছে জমি। মাদার নেচারই যেন প্রকৃত বামপন্থী, সব থেকে বড়ো এবং সৎ রেজিস্টান্স। এক অদ্ভুৎ ডিস্টোপিক ইয়ুটোপিয়া যা প্রকৃতি নির্মাণ করে… অ্যাপোক্যালিপ্স পরবর্তী পৃথিবী (বলে যদি কিছু থাকে), মানুষের তৈরি করা সব কিছু ঢেকে দেবে বড়ো বড়ো গাছ, লতাগুল্ম… পরিত্যক্ত ইমারতের মাঝে বাসা বাঁধবে টিকে থাকা পশু-পাখিরা। হয়ত বিবর্তিত উদ্ভিদ, বিবর্তিত প্রাণীকূল। অথচ, তাদের ট্যাক্সোনমির হিসেব রাখার আর কেউ নেই তখন।
এও কি / এই কি মেলানকোলি?