সেপ্টেম্বর ২০২৫ | September 2025

বিভাগ
বুক রিভিউ
২. ‘সব গদ্যই মেলানকোলিক’ অথবা অন্য রকম কিছুও – একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া
৩. ভারতীয় ভক্তিসাহিত্য এক গুরুত্বপূর্ণ পুনঃপ্রকাশ
৪. অফ স্টাম্পের বাইরে: সপাট স্কোয়ার কাট
* * * * * *

বই: ভারতীয় ভক্তিসাহিত্য
লেখক: বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য
প্রকাশনা: একলব্য
প্রচ্ছদ: রোচিষ্ণু সান্যাল
দাম: ৮৫০ টাকা
ISBN: 978-81-955427-3-4

ভারতে ব্রহ্মা মন্দির কেবল পুষ্করে। কেন এমন হল? একসময় যে ব্রহ্মা ছিলেন প্রধান বৈদিক দেবতা ও তিন প্রাচীন দেবতার ভিতর অগ্রগণ্য, তিনি পুষ্করেই সীমাবদ্ধ থেকে গেলেন কেন? বিষ্ণু অর্থাৎ নারায়ণ, বর্তমান ভারতের প্রধান দেবগণের মধ্যে অন্যতম। অথচ বিষ্ণু একসময় প্রধান বৈদিক দেবতা হিসেবে গণ্য হতেন না। নারায়ণ, বিষ্ণু বা কৃষ্ণ কিংবা রাম কীভাবে হয়ে উঠলেন ভারতের প্রধান দেবতা? পুরাণ যা বলছে, ইতিহাস সবসময় তা বলছে না। দেবগণের মধ্যে কে হয়ে উঠবেন প্রধান আর কে ক্রমশ পিছু হটে যাবেন, তার সমীকরণ এত সহজ বা একমাত্রিক নয়। ভারতের সুপ্রাচীন ইতিহাসে ‘ভক্তি’ এবং ‘ভক্ত’, এই দুটি শব্দের বিশেষ গুরুত্ব আছে। মানুষ বিপর্যয় ও প্রতিবন্ধকতার হাত থেকে রক্ষা পেতে একরকম ঈশ্বরের প্রতিমূর্তি নির্মাণ করে। সেই ঈশ্বর কল্পনা ধীরে ধীরে পুরাণ ও পৌরাণিক আখ্যানের ভিতর প্রবেশ করতে থাকে। বেদ ও উপনিষদ পর্বে এই ঈশ্বর ধারণার ভিত আরও মজবুত হয়। বৈদিক ও তার পরবর্তী সময়ের দেবগণ সাধারণ মানুষের জীবনে এক স্থায়ী অস্তিত্ব কায়েম করে। ভক্তির জোরালো প্রভাব কার্যকরী হয় আসমুদ্র-হিমাচল। পঞ্চ রসের থেকেও বড়ো আকার ধারণ করে ভক্তিরস এবং ভক্তবৃন্দের ভিতর দিয়ে তা প্রবাহিত হয় অতি দ্রুত।
এর ভিতর কার্যকরী হয় এক জটিল আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ব্রহ্মার পরিসর সংকীর্ণ হয়ে যেমন বিষ্ণুর গুরুত্ব একটু একটু করে বাড়তে থাকে, তেমনই গুরুত্ব বাড়ে শিবের। বৈদিক রুদ্র ও অবৈদিক শিব কার্যত হয়ে ওঠেন সমার্থক। অথচ শিবের উদ্ভবের পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ দক্ষিণ ভারতীয় ইতিহাস! অনার্য জনগোষ্ঠীর সাধারণ নেতৃস্থানীয় জনৈক পুরুষ কীভাবে দেবতার স্থান পেলেন? সেই ইতিহাস মোটেই সরল নয়। অনার্য এক দেবতা কীভাবেই বা আর্যাবর্তের প্রধান দেবস্থানীয় হয়ে উঠলেন? রুদ্র এবং শিবের আত্মীকরণ প্রক্রিয়া বিষয়টির ভিতরে অবস্থান করছে ভক্তি আন্দোলনের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য। দক্ষিণ ভারতের এক অনার্য পুরুষের আর্যাবর্তের প্রথম সারির দেবতা হয়ে ওঠার পিছনেও রয়েছে নির্দিষ্ট আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। কেবল এখানেই শেষ নয়, শিবের লিঙ্গরূপে পূজিত হওয়ার পিছনে যেমন রয়েছে একটি পৌরাণিক কারণ, তেমনই এক রাজনৈতিক কারণও বর্তমান।
শুধু শিব, বিষ্ণু বা ব্রহ্মা নন; ভারতের ভক্তি আন্দোলনের পর্ব-পর্বান্তরে রয়েছে আরও বিস্ময়কর ঘটনার উপস্থিতি। যে রাধা-কে আমরা কৃষ্ণ-র আরাধিকা হিসেবে দেখি বা কৃষ্ণপ্রেমে উন্মাদিনী যে রাধিকার পরিচয় পাই, পৌরাণিক অভিমতে তিনি লক্ষ্মীদেবীর এক রূপ। রাধা-কৃষ্ণের উপাসনা বা তাঁদের কেন্দ্র করে ভারতে বহু ভক্ত সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। ভক্তি আন্দোলনের নানা শাখার অস্তিত্বের পিছনেও রয়েছে কৃষ্ণ বা রাধার বিশেষ ভূমিকা। অথচ রাধা ছিলেন এক পুরনারী। গ্রাম্য এই বালিকার প্রসঙ্গ ধরা পড়েছিল প্রাচীন কবিদের কাব্য-সাহিত্যে। কীভাবে রাধা হয়ে উঠলেন শ্রীরাধা? ভক্তিরসের ধারায় কীভাবেই বা এক লোকজ চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে গেল পৌরাণিক চরিত্র হিসেবে?
ইতিহাস এখানেই শেষ হয় না। যে ভক্তিরসের প্লাবন জোয়ার এনেছিল সমগ্র বাংলা জুড়ে, কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা রাধাভাবদ্যুতি সুবলিত গৌরাঙ্গ বা চৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে সঙ্গে বাংলায় যে বৃহৎ পরিসরে বৈষ্ণব ভক্তি আন্দোলন বিকশিত হল, তার শিকড় ভারতের অনেক গভীরে প্রোথিত। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এখানে মহিলাদের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে! কখনো দক্ষিণ ভারতে, কখনো আর্যাবর্তে বা অন্যত্র দেবতাকে আশ্রয় করে তাদের আশ্রিতা হয়ে উঠেছেন বিভিন্ন মহিলা। তাঁরা সাধিকার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন। ভক্তিরসের ধারা প্রবাহিত হয়েছে অনেক গভীরে।
সমগ্র ভারতবর্ষে এভাবেই ভক্ত ও ভক্তির এক নিবিড় যোগসূত্র। উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম ভারতের প্রায় প্রতিটি প্রদেশে বা বলা ভালো আসমুদ্র হিমাচল এই ভক্তিরসের জোয়ারে ভেসেছেন বহু ভক্ত, সমৃদ্ধ হয়েছে সাহিত্যের নানা পরিসর। ভক্তিরস ও ভক্তি আন্দোলনের সাহিত্যিক তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। কখনো তা বাংলায়, কখনো উড়িষ্যায়, কখনো রাজস্থান তো কখনো কর্ণাটকে। সমগ্র ভারতবর্ষে ভক্তি আন্দোলনের ইতিহাস ও বিবর্তনকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে বহু সাহিত্যিক সংরূপ। এই বিষয়ে ইংরেজি বা অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় বেশকিছু কাজ সুলভ হলেও বাংলায় পূর্ণাঙ্গ কাজ দুর্লভ। এখানেই বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে ‘ভারতীয় ভক্তিসাহিত্য’ গ্রন্থটি। যে ইতিহাস এবং পুরাণের প্রসঙ্গ উত্থাপনে কিছু প্রশ্নচিহ্ন এই লেখার সূত্রপাত হিসেবে উঠে এসেছে তার উত্তর রয়েছে আলোচ্য গ্রন্থে। সুবিশাল এই ভক্তিসাহিত্যের নির্মাণ করেছেন পণ্ডিত অধ্যাপক বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য। এমন নিবিড় গবেষণাগ্রন্থ বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। ভারতবর্ষের প্রায় প্রতিটি প্রদেশে ভক্তিসাহিত্যের ইতিহাস কীভাবে প্রোথিত আছে, তার বিশ্লেষণ করেছেন বিষ্ণুপদবাবু। ইতিহাস এবং পুরাণের কাহিনির ভেদচিহ্নগুলিও হয়ে উঠেছে সুস্পষ্ট। কেবল বিশ্লেষণ নয়, ভক্তিসাহিত্যের এবং ভক্তিআন্দোলনের পর্ব-পর্বান্তর জুড়ে যে গোষ্ঠী, সম্প্রদায় এবং ব্যক্তিদের ভূমিকা রয়েছে, তাঁদের বিস্তারিত বিবরণও ধরা পড়েছে এই গ্রন্থে। এই গ্রন্থটি ভক্তিসাহিত্যের আকরগ্রন্থ কেবল নয়, সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে এমন কাজ বিরল। ১৯৬১ সালের পর ২০২৫-এর কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলায় বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্যের ‘ভারতীয় ভক্তিসাহিত্য’ গ্রন্থটি নতুন রূপে প্রকাশ করেছে একলব্য। দীর্ঘ এই গ্রন্থটির একটি বিশদ কথামুখ লিখেছেন প্রখ্যাত অধ্যাপক, জগন্নাথ গবেষক শেখ মকবুল ইসলাম। তাঁর সুচিন্তিত গবেষণা এই কথামুখের মাধ্যমে গ্রন্থটির গুরুত্ব আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কেবল অ্যাকাডেমিক গবেষণা নয়, সর্বভারতীয় স্তরে ভারতের দীর্ঘকালীন ভক্তি ইতিহাসের ক্ষেত্রে এই বই অপরিহার্য। এমন একটি কাজ দীর্ঘদিন অপ্রকাশিত ছিল। একলব্য-র এই প্রচেষ্টা বাংলা সাহিত্য এবং প্রকাশনায় ভীষণ প্রাসঙ্গিক হয়ে থাকবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যত্র ভক্তিসাহিত্য পাঠের ক্ষেত্রে এই গ্রন্থটি, ছাত্র-ছাত্রী ও তরুণ গবেষকদের কাছে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলেই মনে হয়। কেবল একটিই সংযোজন প্রয়োজন, এই দীর্ঘ গবেষণাগ্রন্থের একটি নির্ঘণ্ট বা ইনডেক্স তৈরি করলে বইটি পাঠের ক্ষেত্রে আরও সুবিধা হবে। সামগ্রিক নির্মাণে বইটির প্রোডাকশনে প্রকাশক যথেষ্ট যত্নবান। ভবিষ্যতে তাঁরা এমন কাজ আরও বেশি পাঠকের সামনে নিয়ে আসুন।