
৩
এবার দেখে নিই কবির অপর একটি সমধিক গুরুত্বপূর্ণ দিক। এ-দেশে, কবি অমিয় চক্রবতীর সমকালে সামাজিক শ্রেণি-বঞ্চনা ও শোষণ তিনি লক্ষ করেছেন ক্ষুব্ধ চোখ। এলিয়ট বর্ণিত ফাঁপা মানুষের নকল, ন্যক্কারজনক, অসহায়, অভাবক্লিষ্ট, তুচ্ছ, ভন্ড জীবননির্বাহ কবিকে পীড়িত, ব্যথিত, বিস্মিত করেছে। যেমন এলিয়ট বলেছিলেন: “The burnt-out ends of smoky days” (Prelude), ঠিক তেমনই তেরশ-পঞ্চাশের মহা-আকালের অশ্রুসিক্ত ভয়াবহ ছবি আঁকছেন অমিয়—
“রাতের কান্না দিনের কান্না ঘুরে ঘুরে ওঠে
অন্ন দাও।
মূর্চ্ছা চোখের অন্ন দাও
বোবা বুক বলে অন্ন দাও।
কোথাও পাথর ভাঙে না, ঝরে না অন্ন জল,
কঠিন শহরে অন্ন নেই।”
(‘অন্ন দাও’ — “পারাপার” )
দুর্ভিক্ষ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ে মজুতদারী ও হিংসার বিরুদ্ধে থেকেও সাম্যবাদীদের যুক্তিতর্কে কবি খুব গুরুত্ব দেননি— “বাঁচানো অর্থে বস্তি বাঁচানো নয়, বস্তির বস্তিত্ব / ঘুচিয়ে মানুষকে দেওয়া অস্তিত্ব” (‘সত্যাগ্রহ’ — “পারাপার”)। রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজির মতো অমিয়ও চেয়েছেন মানুষের অন্তরের মনুষ্যত্ব ও বিবেকবোধ জাগ্রত করে উন্মত্ত রক্তক্ষয়ী ভ্রাতৃনাশ, ঘৃণা ও বিদ্বেষ দূর করতে। কোনো সহজ বা দ্রুত সমাধান না পেলেও কবি ভেবেছিলেন— “বর্বরের হাতে দুঃখ পেয়েও নিভৃত করুণার জিৎ / … / পাপের বিরুদ্ধে পাপী হয়ে, হত্যার বদলে হেনে হত্যা-শোক / মাথা নীচু করব না কোটি লোক।” (‘সত্যাগ্রহ’ — “পারাপার”)
বাংলা কবিতার তিরিশের দশকের বিখ্যাত কবিপঞ্চকের (বুদ্ধদেব, জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু, অমিয়) মধ্যে সর্বাধিক ‘আধ্যাত্মিক’ কবি হয়েও অমিয় প্রচলিত অর্থে ঈশ্বরবিশ্বাসী নন। বরং তার কবিতায় ‘ঈশ্বর’ শব্দটি লঘুরসেও লিখেছেন— “দেখলাম দু-চক্ষু ভরে, / হে প্রভু ঈশ্বর মহাশয়” (‘হে প্রভু ঈশ্বর মহাশয়’ — “পালাবদল”)। আবার কোথাও লিখছেন— “ঈশ্বর, মুখে দিয়ে দামি সিগারেট / বসে বসে দেখছেন, / স্বর্গে” (‘মানুষের ঈশ্বর’ — “দূরযানী”)
সুতরাং, গতে বাঁধা রাস্তায় নয় — এই কবির ঈশ্বরকে পাওয়া যাবে সর্বমিলনে, নিবিষ্ট একক প্রাণ ও অন্তরের কঠোর সাধনায়; মানবের সেবায়, কল্যাণে, ঐক্যে, বৈরাগ্যে, ধ্যানে, বোধে, বিজ্ঞানে ও বিশ্বচেতনায়। অমিয় চক্রবর্তী মনে করতেন যে, আমাদের আধ্যাত্মিক চেতনা ও বৈজ্ঞানিক মননের সুষম মিলনেই খুলবে চিরচিদানন্দ আকাশ। অমিয়র মিস্টিক চেতনায় দ্বন্দ্ব বিদ্যমান, যা রবীন্দ্রনাথের মতো সমর্পণী নয়। আবার অন্যদিকে, রবীন্দ্রনাথের মতোই মৃত্যুভাবনায় তিনি কখনও শঙ্কিত হননি। কারণ, মানুষের মর্ত্য প্রাণের মহতী কীর্তি ও অনুভবের লুপ্তি ঘটে বলে তিনি বিশ্বাস করেন না—
“যম নেই প্রাণ—
রেখে দিই লুকিয়ে
তবু একরত্তি
চোখে দিনের সোনা
কানে ভোরের আজান”
(‘সংবিৎ’ — “ঘরে ফেরার দিন”)
সকল বিস্তার ও বিস্ময়, উড়ান ও উত্তরণের শেষেও কবি অমিয় তাঁর উৎসকে ভোলেননি। ভোলেননি এই কথা যে, জীবন আসলে একটি বৃত্ত। শিল্পীর কাজ তাকে যথাসম্ভব নিটোল করে আঁকা। “…হাওয়া উঠলে হাওয়া মুখে লাগানো। / কুয়োর ঠান্ডা জল, গানের কান, বইয়ের দৃষ্টি, / গ্রীষ্মের দুপুরে বৃষ্টি। / আপনজনকে ভালবাসা, / বাংলার স্মৃতিদীর্ণ বাড়ি-ফেরার আশা” (‘বড়োবাবুর কাছে নিবেদন’ — “মাটির দেওয়াল”)। অবশেষে, ১৯৮৩ সালে অসুস্থ অবস্থায় তিনি তাঁর চিরকাঙ্খিত বাংলায় শান্তিনিকেতনে ফিরে এলেন নিজের ঘরে। আর, তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়ে গেল ১৯৮৬ সালে। পেছনে রেখে গেলেন একটি যুগপ্রতিনিধিত্বের বিলীন হওয়ার শূন্যতা। পদ্মভূষণ, সাহিত্য অকাদেমি ও ইউনেস্কো পুরস্কারে ভূষিত কবি অমিয় চক্রবর্তী আজও বারংবার পাঠযোগ্য।
অমিয় চক্রবর্তী-র সাহিত্যকর্মের একটি তালিকা—
খসড়া, ১৯৩৮
একমুঠো, ১৯৩৯
মাটির দেয়াল, ১৯৪১
অভিজ্ঞান-বসন্ত, ১৯৪৩
দূরযানী, ১৯৪৪
পারাপার, ১৯৫৩
পালাবদল, ১৯৫৫
ঘরে ফেরার দিন, ১৯৬৬
হারানো অর্কিড, ১৯৬৬
পুষ্পিত ইমেজ, ১৯৬৭
অমরাবতী, ১৯৭২
অনিঃশেষ, ১৯৭৬
নতুন কবিতা, ১৯৮০
এছাড়াও বেশ কিছু কবিতার অনুবাদক অমিয় চক্রবর্তী। তাঁর প্রবন্ধাবলী হীরকখনিস্বরূপ। নয়টি ইংরেজি গ্রন্থেরও তিনি প্রণেতা।

মুগ্ধ হলাম। সমৃদ্ধ হলাম।
অপূর্ব লেখা।